অদৃশ্য ‘নোভেল করোনা’ নামক ভাইরাস জ্বরে জর্জিরিত তামাম দুনিয়া। ইতোমধ্যে করোনাঘাতে বাঁচার আকুতি নিয়ে আকাশপানে কাঁদতে দেখা গেছে মানবতার শহর ইতালিকে। বিধ্বস্ত বাণিজ্যিক শহর চীন। অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে মেডিসিনের শহর সুইজারল্যান্ড। নিরুপায় হয়েছে খোদ প্রযুক্তির শহর জার্মানি। ক্ষমতার দেশ আমেরিকাও দিশেহারা। শক্তিধর কানাডা নিঃসঙ্গ! ব্রিটিশের দেশ ইংল্যান্ড খোঁজে পাচ্ছেনা বাঁচার কোনো পথ, অস্ত্রের রাজাখ্যাত রাসিয়া-ফ্রান্সও নিস্তব্ধ, রক্ষণশীল সৌদি-ইরান-ইরাক-পাকিস্তান টালমাটাল, পোশাকের বাংলাদেশও অল্পতেই বেদশায় নিমজ্জিত। বলা যায়, চলমান বিশ্বকে কে যেনো থামিয়ে দিলো। পরিস্থিতি এমন যে, ব্যাক গিয়ারে যেনো চলছে এগিয়ে যাওয়ার বিশ্ব!
আমাদের দেশেও আঘাত হানতে করুণা করেনি ঘাতকব্যাধি করোনা। বরং পুরো দেশ লকডাউন আর একে অপরের সঙ্গে সামাজিক দূরন্ত সৃষ্টি করে নয়া ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। গত ৮ মার্চ করোনা ভাইরাসবাহী রোগীর অস্তিত্ব চিহ্নিত হয় বাংলাদেশে। ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বর। সারা বিশ্ব করুণার চোখে চেয়েছিল চীনের উহান শহরের দিকে। আহা! কী ভয়াবহ দুর্যোগ। ২০১৯ সালে শুরু হয়েছিল বলে দুর্যোগের নাম হয় ‘কোভিড-১৯’। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে আঘাত হানে ১৮৩টি দেশে। এখন হঠাৎই যেনো নতুন ক্লাইমেক্স শুরু হয়েছে। চীনের প্রতি অনুকম্পা উল্টে গিয়ে চীনই যেনো এখন সারা বিশ্বের জন্য অনুকম্পা দেখাতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে করোনাঘাতে সমগ্র ইউরোপ যেনো দিশাহারা। ভূমধ্যসাগর তীরে ইতালি যেনো বিশ্বের সবচেয়ে বেশী করোনাঘাতে কাঁপছে। থরো থরো কাঁপা ইতালির একটি আলোকচিত্র যে কারো মাথা খারাপ করে দিতে পারে। উত্তর ইতালির বেরগেমো এবং লম্বার্ডিতে লাইন দিয়ে চলছে সাঁজোয়া ট্রাকগুলোতে দেখা গেছে করোনায় সারি সারি লাশ। কবরখানায় জায়গা নেই আর। তাই, শত শত ট্রাক চলছে শহরের বাইরে কোনো ‘নিরাপদ’ জায়গায় মৃতদেহগুলোর সৎকার করতে। কেবল গত ২১ মার্চ সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৭৯৩ জনের। এমন পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায় ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি উক্তিতে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী রোবার্তো স্পেরানজা বলেছেন ‘ইতিহাসে যতো কঠিন মুহূর্তের সাক্ষী আমরা, তার মধ্যে এটা সবচাইতে ভয়াবহ। একটা নতুন ভয়ংকর শত্রু আমাদের জীবনে ঢুকে সব কিছু উলট-পালট করে দিয়েছে। সামনে আরো কঠিন সময়।’ মৃত্যুর মিছিলে ইতালির পর রয়েছে স্পেন। এরমধ্যে নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র।
করোনা বিপদ কোথায় কত দূর প্রসারিত হবে, কখন কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণে আসবে, ভবিষ্যতে তার নতুন কোনো মূর্তি দেখা যাবে, ওই মূর্তি তুলনায় কম বিপজ্জনক হবে, না বেশী হবে? এসব নানাবিধ প্রশ্নের জবাব আপাতত অজানা। অসার এবং অবান্তর জল্পনা সেই সদুত্তরের বিকল্প হতে পারে না। বরং তা নানাবিধ দিক দিয়েই ক্ষতিকর। এ ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ এবং তার সাথে মানুষ তথা বৃহত্তর প্রাণিজগতের লড়াইয়ের ইতিহাস শুধু দীর্ঘই নয়, বরং সমৃদ্ধও। ওই ইতিহাসের ধারাতেই এ ক্ষেত্রেও সংক্রমণের প্রতিষেধক এবং ব্যাধির ঔষধ খুঁজবার উদ্যোগ জোর কদমে চলছে। তার সাফল্যের সম্ভাবনা কম নয়। কিন্তু ইতিহাসই স্বাক্ষ্য দেয় যে, ওই সাফল্য মিলবার পরেও নয়া বিপদের আশঙ্কা থেকে যেতেই পারে। কারণ ব্যাধির বীজ ক্রমাগত নিজের পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে, ওই পরিবর্তনের মোকাবিলায় পুরানো ঔষধ অকেজো বা অপটু হয়ে পড়ে, নতুনতর ঔষধ আবিষ্কারের প্রয়োজন ঘটে।
ইতোমধ্যে পৃথিবীর সিংহভাগ দেশে কয়েক কোটি মানুষের দেহে করোনা ভাইরাসটির সন্ধান মিলেছে। এতে অন্তত কয়েক লাখ প্রাণ না ফেরার দেশে চলে গেছে। অথচ সংক্রমণের প্রতিষেধক বা ঔষধ এখনো তৈরি করা শতভাগ সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, মরণব্যাধি করোনার সাথে আপাতত অসম লড়াই চলছে। করোনার আঘাত থেকে রক্ষা পেতে হাতিয়ার কিংবা অস্ত্র হিসেবে ‘সচেতন এবং সতর্ক দায়িত্ববোধ’ এর বিকল্প নেই।
দায়িত্ববোধ যেমন নিজের প্রতি। তেমনই অন্যের প্রতিও থাকতে হবে। সংক্রমণের সম্ভাবনা হতে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা, জনসমাগম যথাসাধ্য এড়িয়ে চলবার পরামর্শ, নিজের শরীর, বিশেষত হাত দুইটিকে যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখার এসব পরামর্শই প্রাথমিকভাবে নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ অনুশীলনের কথাই জানান দেয়। কিন্তু এসবের প্রতিটি অভ্যাসই আবার অন্যের সংক্রমণের আশঙ্কাও কমিয়ে দেয়। নিজে জীবাণুমুক্ত থাকলে যেমন নিজের লাভ, তেমনই অপরেরও লাভ। আবার, নিজে সংক্রমিত হলে বা তার কোনো লক্ষণ বুঝলে অবিলম্বে নিজেকে অন্য সবার সংস্পর্শ হতে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশটি সরাসরি সামাজিক দায়িত্বকেই চিহ্নিত করে। সংক্রমণের মোকাবিলায় ব্যক্তি-মানুষের নিকট সামাজিকতার এ দাবি মনে করিয়ে দেয় যে, অনেকের সাথে জীবনযাপনকে ভাগ করে নিতে হয় বলেই সামাজিক মানুষের নিরাপত্তা পরস্পরের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করে।
এ পারস্পরিকতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার অগণিত নিদর্শন চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশ্ব পরিবেশ দূষণের অতিকায় সঙ্কটের চেহারা এবং চরিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, পৃথিবী নামক গ্রহটির সমস্ত অধিবাসী একে অন্যের উপর কী অনুপাতে নির্ভরশীল; তা অজানা থাকবার কথা নয়। আধুনিক অর্থশাস্ত্র ব্যক্তিস্বার্থ-প্রধান, অনেকাংশেই ব্যক্তিস্বার্থ-সর্বস্ব। কিন্তু ওই শাস্ত্রও এ পারস্পরিকতাকে অস্বীকার করতে পারে না, ‘এক্সটার্নালিটি’ বা অতিক্রিয়ার ধারণাটি উদ্ভাবন করেছে। মানুষ যা করে তার পরিণাম বিচারের জন্য এর বিবেচনা জরুরি। ব্যক্তিগত ভালমন্দ, প্রাতিষ্ঠানিক লাভক্ষতি, আঞ্চলিক বা জাতীয় স্বার্থ যে কোনো স্তরের সীমাবদ্ধ হিসাব-নিকাশের বাইরে বৃহত্তর পরিসরে ওই পরিণাম প্রসারিত হয়। বস্তুত, এটা নিছক অতিক্রিয়া নয়, মানুষের এ পারস্পরিকতায় নিহিত রয়েছে এক গভীরতর জীবনদর্শনের সূত্র। যা অপরকে আপনার সাথে এবং আপনাকে অপরের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখবার সূত্র।
করোনায় মানসিক জগৎ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলে গিয়েছেন, ‘মনুষ্য-জীবন প্রকৃতির সঙ্গে দীর্ঘ সমর মাত্র!’ একবিংশ শতাব্দীর মানুষেরা বোধকরি এই ‘সমর’ তথা যুদ্ধের কথা এভাবে কখনো কল্পনা করতে পারেনি। করোনা ভাইরাস যেভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। ভাইরাসটির কারণে বিশ্বব্যাপী শত শত কোটি মানুষ এখন স্বেচ্ছাগৃহবন্দি। প্রশ্ন আসতে পারে, একজন মানুষ কতদিন যাবৎ ‘স্বেচ্ছায়’ গৃহকোণে অন্তরিন থাকতে পারেন?
সর্বশেষ বড় আকারে মহামারি দেখা দিয়েছিল শত বছর আগে। স্প্যানিশ ফ্লুতে ১৯১৮ সালের জানুয়ারি হতে ১৯২০-এর ডিসেম্বর অবধি দুুই বছরের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিলেন বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৫ কোটি মানুষের! করোনা ভাইরাসে যেমন মৃত্যুহার সবচাইতে বেশী বয়স্ক মানুষদের মধ্যে, স্প্যানিশ ফ্লু ছিল এর বিপরীত। ওই ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে সবচাইতে বেশী মৃত্যু হয়েছিল ২০ হতে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের। স্প্যানিশ ফ্লুতে কেউ আক্রান্ত হওবার পর তা ভালো করে অনুধাবনের আগেই অনেকের মৃত্যু হতো। এতটাই ভয়াবহ ছিল ওই সংক্রমণ। বিষয়টা অনেকটা এই রকম ছিল যে, কোনো ব্যক্তি হয়তো ঘুম হতে উঠে নিজেকে বেশ দুর্বল মনে করছেন, তিনি প্রাত্যহিক সকল কাজ গুছিয়ে হয়তো কাজে বাহির হবেন, দেখা গেলো একটু পরই তার জ্বর এসেছে। সাথে যোগ হয়েছে শ্বাসকষ্ট! বমি এবং নাক দিয়ে রক্তপাত শুরু হতেই দেখা গেলো আক্রান্তের সঙ্গিন অবস্থা। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল মাত্র। ইউরোপে অস্থিরতা, ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ, সব মিলিয়ে স্প্যানিশ ফ্লু হতে বাঁচতে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে গৃহে ‘অন্তরিন থাকবার থিউরি’ তখন কেউ প্রদান করেননি। সকল কাজকর্মই চলেছে এবং লকডাউনের তেমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি।
কিন্তু এবার করোনাকালে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ যখন লকডাউনের কারণে গৃহবন্দি হতে বাধ্য হচ্ছে, তখন ওই গৃহকোণে তাদের মানসিক জগৎও যেনো তালাবন্ধ হয়ো যাচ্ছে! আমরা বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের দিনগুলোর কথা জানি, নেলসন ম্যান্ডেলার কনডেম সেলে প্রায় তিন দশক বন্দি থাকবার কাহিনী জানি, নজরুলের নির্জন কারাবাসের কাহিনী জানি, ঠুনকো মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসের ও কথা ভুলিনি। কিন্তু জানি না বিশ্বব্যাপী এমন কোটি কোটি মানুষের অদ্ভুত গৃহবন্দি দিনের কথা। সবাই তো আর বঙ্গবন্ধু, ম্যান্ডেলা কিংবা কাজী নজরুলের মতো মানসিক শক্তি ধারণ করেন না। সেকারণে বন্দিত্বের এমন শিকল যেনো আঁকড়িয়ে ধরছে কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে, যেভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং হতে যাচ্ছে ওই সব সংকটের পাশে করোনা-উত্তর কোটি কোটি মানুষের মানসিক বিকারের জগৎও এ বিশ্বকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে। আমরা এখনো জানি না, কতদিন গৃহ-অন্তরিন থাকলে দেখা মিলবে করোনা-উত্তর যুগের। কতো সপ্তাহ, কতো মাস এভাবে পার করতে হবে? কিন্তু এটুকু কেবল বলা যায়, এ বিশ্ব নতুন করে চিহ্নিত হবে করোনা-পূর্ব এবং করোনা-উত্তর যুগ হিসাবে। ওই নতুন যুগের হিসাবটা সব দিক হতে জটিল হবে। তার পরও, যত কষ্টই হউক, লকডাউনেই থাকতে হবে প্রতিটি দেশের সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। থাকতে হবে ‘সতর্ক’। এটাই এ রোগের এখন পর্যন্ত একমাত্র দাওয়াই।
বিশ্ব-উষ্ণায়নের মতোই, সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণও জানিয়ে দেয়, এটা শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়, বরং জীবন-মরণের কঠোর বাস্তবতাও বটে। অতিবড় বিচ্ছিন্নতাবাদীও এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না। নোভেল করোনা ভাইরাস ওই বাস্তবকেই আরও এক বার প্রকট করে তুললো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা অনুসরণ করে বলা চলে, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় যেনো এক বিন্দু আপস না করা হয়। আর এটাই হবে নিজের ও সবার জন্য মঙ্গল। সুতরাং করোনার পরিণতি কী হতে পারে, সেটাই এখন ভাববার বিষয় বটে।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)