এই শতাব্দির একটি দুঃসময়ের নাম কোভিড-১৯ ভাইরাস। যা জীবন ও জীবিকাকে থামিয়ে দিয়েছিল। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করলেও শুরুতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় নিজেকে রক্ষায় এবং এই ভাইরাস ছড়িয়ে পরা ঠেকাতে লক ডাউন দেওয়া হয়। লক ডাউনের সময় বন্ধ থাকে সবকিছু। থমকে দাঁড়ায় বিশ^ অর্থনীতি। কারণ আমদানি রপ্তানি, বিমান চলাচলসহ যোগাযোগ স্থগিত থাকে। করোনা অতিমারির কারণে অন্যসব খাতের সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পর্যটন খাত। সারা বিশে^ই এই খাত করোনার কারণে বিপর্যস্থ হয়। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে প্রায় সব দেশই লক ডাউনের পথে হাঁটে। সেই সময় পর্যটন ক্রেন্দগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ যে পর্যটকদের জন্য পর্যটনকেন্দ্র সেই কেন্দ্রগুলো পর্যটকরশূন্য থাকে। এর সাথে জড়িত সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ থাকে। সেই সাথে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটন কেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটকশূণ্য দীর্ঘদিন পরে থাকে পর্যটনকেন্দ্রগুলো। এক প্রতিবেদনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪০ লাখ জনবল বেকার হয়ে পরেছিল। তারপর একসময় ধীরে ধীরে করোনার প্রকোপ কমতে থাকে সারা বিশে^ই। তখন পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হয় পর্যটনকেন্দ্র। আমাদের দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে পর্যায়ক্রমে।
আমাদের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র সুন্দরবনের সব স্পট ১ নভেম্বর থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে খুলেছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের হোটেলগুলো এবং বাংলাদেশের দার্জিলিং খ্যাত সাজেক ভ্যালী। এভাবেই ক্রমেই পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভ্রমণ শুরু হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই করোনার বাস্তবতা কাটিয়ে আগের মতো পর্যটক মুখরিত হয়ে হবে না কেন্দ্রগুলো। এর জন্য সময় প্রয়োজন। কারণ এখনো করোনার প্রকোপ সারাবিশে^র সাথে আমাদের দেশেও রয়েছে। তাছাড়া ইউরোপ জুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। সেই ঢেউ আমাদের দেশেও লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে কতৃপক্ষ। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে থাকা করোনাকে হাতের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনাহেতু অনেকেই কোলাহলপূর্ণস্থানে ভ্রমণে নিরুৎসাহী। পৃথিবীজুড়েই পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা পালন করছে। তাই বিভিন্ন দেশ তাদের পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করছে। পর্যটকদের আবাসন ব্যবস্থা,নিরপত্তা,খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা,শপিং,ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানানোর ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে পর্যটন শিল্পের ওপর।
বিশ^ ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) এর তথ্যানুযায়ী, বিশ^ অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের অবদান ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্প বিশে^র জিডিপিতে অবদান রাখে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। তাই এই শিল্পের বিকাশ লাভ আবশ্যক। করোনা পরবর্তী সময়ে এখনও দেশের পর্যটনশিল্প জমে ওঠেনি। এখন হেমন্তকাল চলছে। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। শীতের এই সময় থেকে শেষ পর্যন্ত দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের ভিড় থাকে। মানুষ সতর্কতা নিয়েও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যেতে আরম্ভ করেছে। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। যেসব স্থান ভ্রমণ করতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা প্রতি বছর ভিড় করে। এসব পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম হলো কক্সবাজার। পৃথিবী বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত ছাড়াও আরও ভ্রমণস্থান রয়েছে এখানে। রয়েছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। আমাদের পাহাড় সমৃদ্ধ পাবর্ত্য তিন অঞ্চল রাঙামাটি,বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। সাজেক ভ্যালি,নিলাচল,নীলগিরি,বিছানাকান্দি,চা-বাগান, রাতারগুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পর্যটকরা ছোটেন সেখানে। এসব ছাড়াও প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে পর্যটনকেন্দ্র। সেসব কেন্দ্রে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যান ভ্রমণ পিপাসুরা।
আমাদের দেশের প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। রয়েছে আলাদা বিখ্যাত পর্যটনসমৃদ্ধ স্থান। যেসব স্থান ঘিরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা বাণিজ্য। এসব পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে প্রচুর কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে। নারী-পুরুষ তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘ কয়েক মাস এসব মানুষ দুর্ভোগে ছিল। এখন তারা আবার আগের জীবনে ফিরছেন। তবে তা ধীরগতিতে। এখন কতৃপক্ষের দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেসব স্থান চলাচলের উপযোগী করে তুলতে হবে। দেশের পর্যটন শিল্পকে ঘরে দাড়াতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ঘুরে দাড়ানোর জন্য এই খাতের পূর্ণ গতিতে চলা প্রয়োজন। কিন্তু এখনো করেনা মহামারীর প্রকোপ চলছে। এর মধ্যে পর্যটন শিল্পকে বিশ^মানের করে তুলতে হবে যাতে আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ সালে বিশে^ পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৩৩৫ মিলিয়েনে দাড়িয়েছে। পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করলে আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশ সমাধান করা সম্ভব। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং দেশের অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে এই পর্যটনশিল্প। তাই করোনা মহামারীর পর যাতে তা দ্রুত গতিতে বিকাশমান হতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
অলোক আচার্য
কলাম লেখক,পাবনা