ধর্ষণ বা নারীর ওপর অত্যাচার, সামাজিক বিচারের নামে প্রহসন এই সমস্যাগুলি যা মধ্যযুগীয় সময়ের স্বাক্ষ্য বহন করে এবং কোনোভাবেই সভ্যতার উৎকর্ষতার নির্দেশ করে না তা কেবল আমাদের দেশের সমস্যা নয় বরং বিশে^র বিভিন্ন দেশের বিশেষত বাংলাদেশ,ভারত,পাকিস্তান অথবা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি দেশই কাজ করে চলেছে। আমরাও চাইছি যেন দেশ নারী নির্যাতনমুক্ত হয়। ধর্ষণমুক্ত হয়। খবরের কাগজ খুললে ধর্ষণের মতো নিগ্রহ বা নির্যাতন পড়তে না হয়। অন্তত প্রতিদিন আমরা যা পড়ছি। নারী আসলে কোথায় নিরাপদ সে প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় নারী কোথাও নিরাপদ নয়। এমনকি মরেও নিরপদ নয়। সম্প্রতি মর্গে রাখা ছয় নারীর লাশের সাথে বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এক ডোম যাদের ধর্ষণ করেছে। এ ধরনের ঘটনা ইতিহাসে আরও আছে। এই বিকৃত যৌনাচার এক ধরনের মানসিক রোগ। যারা প্রতিনিয়ত নারীর ওপর অত্যাচার করছে তারাও কি সুস্থ? যারা শিশু ধর্ষণ করছে তারা কি সুস্থ মস্তিষ্ককের কেউ? প্রতিনিয়ত এসব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ধর্ষণ মামালার বিচারে অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। ধর্ষণের মতো প্রতিনিয়ত ঘটনার লাগাম টানতে বা নারীর সুরক্ষায় অপরাধীর এই শাস্তির প্রয়োজন ছিল। তারপরেও ধর্ষণের ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। এখন ধর্ষণ মামলার বিচারও খুব দ্রুত হচ্ছে। সম্প্রতি পাকিস্থানে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিতহলেই ধর্ষককে রাসায়নিক ইনজেকশন দিয়ে তার পুরুষত্ব হরণ করা হবে,এই মর্মে একটি আইন পাস হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানেরও অনুমোদন মিলেছে। সেদেশের অন্যতম প্রধান টিভি নিউজ চ্যানেল জিও টিভি জানিয়েছে, দেশে ক্রমবর্ধমান যৌন নিগ্রহ ও ধর্ষণের ঘটনা রুখতে সরকার বাধ্য হচ্ছে এই ব্যবস্থা নিতে। আগেই বলেছি নারীর ওপর নির্মমতার এই ধরনের ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই ঘটছে না। প্রশ্ন হলো মানসিকতা যদি পরিবর্তন বা উন্নত না হয় তাহলে কি কেবল আইনের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনার লাগাম টেনে ধরা যাবে।
অনেক ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচার তো সামাজিকভাবেই করা হচ্ছে। সেই বিচার বেশিরভাগ সময়ই নারীর বিপক্ষে যাচ্ছে এবং তাদের আরও সামাজিকভাবে হেয় করছে। সামাজিক বিচার ব্যবস্থা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিচারের নামে এসব প্রহসনের ব্যবস্থাও বন্ধ করা জরুরি। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি ন্যাক্কারজনক একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হলে সামাজিক বিচারের নামে মেয়েটিকে ৮৫ বছরের এক বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। এটা সামাজিক বিচারের নামে অবিচারের একটিমাত্র উদাহরণ। প্রায় সময়ই নির্যাতিতাকে দোররা মারা এমনকি গ্রাম ছাড়াও হতে হয় লোকলজ্জার ভয়ে। তারপরও এসব সামাজিক বিচার চলছে। সমাজে বসবার করার দরুণ তা মেনেও নিতে হচ্ছে। তবে নারীর প্রতি এই অবিচার কতকাল ধরে চলবে যেখানে নির্যাতিতাকেই প্রহসনের শিকার হতে হয়। তার শরীর ও মন আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়? কেবল আইন এর সমাধান হতে পারে না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালে আমরা যে ভয়ংকর নৈতিক স্খলনের চিত্র দেখছি তা আমাদের মনে আতংক ধরায়। কোন সমাজের পথে যাচ্ছি আমরা? কেন মানুষগুলো ক্রমেই হিং¯্র হয়ে উঠছে? সম্প্রতি এরকম ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে। যারা এসব কর্মকান্ড ঘটছে তারা অনেক সময় নিজের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে কোন রাজনৈতিক দলের লেবাস ব্যাবহার করছে। আদতে এসব মানুষ দলের জন্য বোঝা। এদের জন্যই দল সমালোচিত হয়। তাই সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত যে কাউকে কোন দলেরই কোনভাবে সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। সাত মাস থেকে সত্তুর বছর। ধর্ষিতা হয়ে চলেছে কত নারী। কেউ কারও বোন কারও স্ত্রী কারও বা আতœীয়। হামাগুড়ি দিয়ে যেন সাপের মত ফণা তুলে প্রতিদিন ধর্ষকরা ঘুরে বেড়ায়। ওৎ পেতে থাকে অন্ধকারে। তারপর নৃশংস থেকে নৃশংসতম হয়ে ওঠে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে । এটা একটা ভাইরাসের মত ছড়িয়ে চলেছে। শুধু প্রতিষেধকটা জানা নেই।
একজন দুইজন করে প্রতিদিন সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণ মানে তো শারিরীক মৃত্যু নয়। তবে তা মানসিক মৃত্যু। বেঁচে থেকেও সে মরে থাকে। আবার ধর্ষণের পর মুখ বন্ধ করতে মেরেও ফেলছে। নৃশংস থেকে নৃশংসতম ঘটনা আমরা দেখে চলেছি। সভ্য সমাজে অসভ্য বর্বদের পদচারণায় ক্রমেই ধরণী ভারী হয়ে উঠছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার যেন কোন উপায় নেই। পশুবৃত্তি যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে চেপে বসেছে যেন সেখান থেকে আলোর পথ দেখিয়ে মনুষ্যত্ব পথ দেখানোর কেউ নেই। সমাজে ধর্ষণকারীদের দাপটই বেড়ে চলেছে। যেখানে নারী পুরুষ সমতার জন্য আমরা লড়াই করছি সেখানে ধর্ষণের ঘটনা আমাদের পেছনে ধাবিত করে। আবার অনেক ধর্ষকদের পেছনেও রাজনৈতিক ইতিহাস থাকে। যে কোনো স্থানে নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। বাস বা লঞ্চ কোথাও যেন নিরাপত্তা নেই। সুস্থ সমাজ গঠনে ধর্ষণের মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে হবে। সমাজের অধঃপতন ঠেকাতে ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে। না হলে আমাদের প্রতিদিন ভয়ংকর সব নারী নির্যাতনের খবর পড়তে হবে। যখন সমাজের আর উত্তরণের কোনো পথ থাকবে না। ধর্ষণ রুখতে আইনের প্রয়োগের সাথে সাথে সমাজকে শুদ্ধ করতে হবে। যে সমাজে মানুষ থাকবে কোনো অমানুষ থাকবে না। সেভাবেই শিশু,কৈশোর এবং যৌবনে শিক্ষা দিতে হবে। সুস্থ সমাজ ছাড়া সুস্থ মানুষ আশা করা দুরাশামাত্র।
ধর্ষণের মতো মনোবিকৃতি অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণা সবসময়ই ছিল এবং থাকবে। ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যেও দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে। এতেই বোঝা যায় ধর্ষণকারীরা কতটা বেপরোয়া বা তাদের মানবিকতা কতটা পশুত্বে রুপ নিয়েছে যে দেশের মানুষের ঘৃণাও তাদের স্পর্শ করছে না। আইন হয়েছে। ধর্ষণকারীরা আইনের আওয়তায় আসবে এবং অপরাধ অনুযায়ী শাস্তিও পাবে। কিন্তু সমাজের মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করতে না পারা পর্যন্ত ধর্ষণ বা নারীর প্রতি নির্যাতন রোধ করা সম্ভব হবে না। নারীর জন্য এই সমাজকে নিরাপদ করতে হলে প্রথমে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে নারীকে সম্মান দেওয়া হয়, নারীকে উন্নয়নের অংশীদার মনে করা হয় এবং সর্বোপরি নারীকে সহানুভূতি বা সহমর্মিতা দিয়ে নয় বরং তার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হবে। পশুত্বকে বের না করতে পারলে মনুষ্যত্বের স্থান হয় না। আমরা মনে প্রাণে পশুত্বকে বরণ করে নিচ্ছি। ফলে মনুষ্যত্ব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের আইন ও সহায়তা এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গত অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজার ৩৪৯ জন নারী। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জনকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৭১ জনকে। এটি দেশের নয়টি পত্রিকার তথ্য। এর বাইরেও আরো ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টা ঘটনা ঘটেছে। কারণ বহু ঘটনা আমরা দেখেছি ধর্ষণের বহু পরে প্রকাশিত হয় অথবা সামাজিক চাপে প্রকাশ করে না নির্যাতিত। যা আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। সারা দেশের মানুষ এসব ঘটনায় ঘৃণা প্রকাশ করছে। ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে মানুষ রাজপথে নেমেছে। ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট বর্বোরচিত কাজ যারা করছে তাদের মধ্যে যেমন সার্টিফিকেট ধারী আছেন আবার অশিক্ষিতও আছে। আছে প্রায় সবশ্রেণি পেশার মানুষ।ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেলে বুঝতে হবে নারীদের জন্য ক্রমেই অনিরাপদ এবং ভয়ংকর হয়ে উঠছে প্রতিটি অলি-গলি। এমনকি নিজের ঘরও নিরাপদ নয়। যেখানে কেউ নিরাপদ নয় সেখানে সমাজ সুস্থ রাখা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এই সমাজ আদৌ কবে ধর্ষকমুক্ত বা নারী বান্ধব হবে তা আজ প্রশ্নের মুখে। যখন নারীরা মহাকাশে, সাগরে,রণক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যুদ্ধ করছে বা আগেও করেছে সেখানে তাদের ওপর পৌরষত্বের নামে এই অত্যাচার মেনে নেওয়া যায় না। এটা আমাদের মানসিকতার বিকারকে নির্দেশ করে।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলাম লেখক, পাবনা