বছরের শুরুতে পাঠশালা প্রাঙ্গণে যখন পা রাখছিলাম তখন সবে মাত্র শিশুদের সকালের এস্বেমলি শুরু হয়েছিল। শিক্ষকের কথা মতো ওরা হাত উপরে তুলছে আবার নামাচ্ছে। আবার কাউকে দেখছি কিছুই করছে না শুধু দাঁড়িয়ে আছে। কেউবা না দাঁড়িয়ে টুলে বসে শারীরিক খসরত চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ বসে আছে। এভাবেই চলছে সকালের এসেম্বলি। কারণ ওরা আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়। ওরা সবাই ব্যতিক্রমী শিশু। সমাজে যারা প্রতিবন্ধী শিশু হিসেবে পরিচিত। এই ব্যতিক্রমী শিশুদের জন্য যিনি এই অঁজপাড়া গাঁয়ে আলোর কারখানা খুলে বসেছেন তিনি নিজেও একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। শত বাঁধা পেরিয়ে সে যেমন সফল হয়েছেন, সেই সফলতার পথে নিয়ে যাচ্ছেন এই শিশুদেরও। ব্যতিক্রমী সফল মানুষটির নাম ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া মাবন। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের এক নিভৃত গ্রাম গোথালিয়া। সেখানে তিনি ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী শিশু পাঠশালা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। পাঠশালায় বর্তমানে ১৫২ জন প্রতিবন্ধী শিশু পড়াশুনা করছে, যাদের অধিকাংশ অটিস্টিক, বুদ্ধি, সেরিব্রাল পালসি ও ডাউন্স আক্রান্ত শিশু। চাকরির পাশাপাশি মাহবুব যেমন সে¦চ্ছাশ্রম দিচ্ছেন এই প্রতিষ্ঠানে, তাঁরই দেখানো পথে পাঠশালার ১৮ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও ভ্যানচালকও স্বেচ্ছাশ্রমে সমাজের এই অবহেলিত শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মাহবুবের গল্পের যাত্রাটা ঠিক এখান থেকে নয়, যেতে আরো অনেক পেছনে।
বই-খাতা নয়, মাহবুব শৈশবে প্রথম হাতে নেন হাঁটার জন্য লাঠি। যে বয়সে শিশুরা দুরন্তপনা করে এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে বেড়ায় সেই বয়সে সে ছিল ঘরবন্ধী। লাঠি ভর দিয়ে কিছুটা বাড়ির পাশের স্কুলে যায় কিন্তু অন্য শিশুরা তাকে খেলায় নেয় না। শিক্ষকরা একদিন বাবাকে ডেকে বলেন, ওতো ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। পড়াশুনা করে তেমন কিছু করতে পারবে না বরং ওকে আল্লার রাস্তায় পড়াশুনা করান। বাবা উপায়ন্ত না দেখে ৫ মাইল দূরের এক হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তিও করিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানার মৌলভী সাহেবও একদিন বাবাকে ডেকে বললেন, ওতো একা দাঁড়াতে পারে না। ও ইমামতি করবে কিভাবে? ওকে নিয়ে হাতের কাজ শিখান। তাহলে বড় হয়ে জীবনটা কোন রকম চালাতে পারবে। ১ বছর দর্জির কাজও শিখেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না ‘ওর’। একখানা অবশ পা, একটা বাঁশের লাঠি আর মা, এই ছিল ১০ বছর পর্যন্ত মাহবুবের নিত্য সহচর। কিন্তু সব আঁধার পেছনে ফেলে সে এখন এলাকার অসহায় প্রতিবন্ধী মানুষের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় হতে বিবিএ,এমবিএ করে চাকুরির পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নিজের যাপিত জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ২০১০ সালে এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন। ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধব, সমব্যথী, শুভাকাংখী, স্থাণীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ৩ হাজারের অধিক অসহায় প্রতিবন্ধী পরিবার, দুস্থ কৃষক পরিবার ও বয়স্ক ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে চিকিৎসাসহ ঔষধ। ফাউন্ডেশনের অধিনে কোভিড প্রাদুভার্বে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লক্ষ টাকার অধিক খাদ্যসামগ্রী উপজেলার প্রশাসনের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে জেলার বাজিতপুর, কটিয়াদী ও নিকলী উপজেলার প্রায় ১২শ এর অধিক প্রতিবন্ধী শিশু পরিবার, দরিদ্র কৃষক, জুতার কারিগর, হিজড়া ও নরসুন্দরদের মাঝে বিতরণ করা হয়। প্রতিবন্ধী-বান্ধব শিক্ষায় অবদানের জন্য প্রতি বছর দেওয়া হয় শিক্ষক পুরস্কার। নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে প্রতিবন্ধী ও কৃষক মেলা। ২শ’ এর অধিক দারিদ্র প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধী পরিবারের নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ ও ক্ষেত্র বিশেষে দিচ্ছেন বিনামূল্যে সেলাই মেশিন। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম, সফল শিক্ষার্থী সংবর্ধনা, অসহায় ও প্রতিবন্ধী ভিক্ষকু পুনর্বাসন যাকাত ফান্ড, শিক্ষার্থীদের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গঠনে বিতরণ করেন বিনামূল্যে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা।
মাহবুব জানান, ‘প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা দেখে দেখে বড় হয়েছি। তাই প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কিছু করবার তাগিদ থেকেই ২০১০ সালে অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক ভূইয়ার সহযোগিতায় গড়ি মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন। এরপর থেকে দেশি-বিদেশি কোনো দাতা বা দাতা সংস্থার কোনোরকম আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’ প্রায় ১০ বছরে তিন হাজারের বেশি প্রতিবন্ধী, প্রবীণ ও সহায়হীন ব্যক্তি বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন। চিকিৎসাসেবায় পাশে ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন দেবনাথ। পরবর্তীতে ফাউন্ডেশনের অধীনে ২০১৫ সালে স্থানীয় এমপি মো. আফজাল হোসেনের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল “মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী শিশু পাঠশালা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ক্যাম্পাসে নির্মিত হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুবান্ধব (সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি ও ধমীয় শিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, কাউন্সিলিং, সকল ধরণের থেরাপির ব্যবস্থা) একটি আধুনিক ১২৪ ফুট র্দৈঘ্য ও ২২ ফুট প্রস্থত ডা,. মেহেরুল হুদা অ্যাকাডেমিক ভবন।
এই সংগঠন থেকে দুই শতাধিক দরিদ্র প্রতিবন্ধী ছাত্রকে ইতোমধ্যে এককালীন বৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়েছে। মৃত্তিকার সহায়তা নিয়ে একই পরিবারের পাঁচজন প্রতিবন্ধী ভাইবোন এখন লেখাপড়া করছে। বাজিতপুরের বিলপাড় গজারিয়া গ্রামের এ পরিবারের দুই ছেলেমেয়ে সুজন ও মার্জিয়া গুরুদয়াল সরকারি কলেজ ও বাজিতপুর কলেজে সম্মান চূড়ান্ত বর্ষে পড়ছেন। সুজন-মার্জিয়ার মা ফুলবানু বলেন, ‘মৃত্তিকা না থাকলে আমার ঝি-পুতাইনতে (ছেলেমেয়ে) ভিক্ষা কইরাও ভাত পাইত না! অহন তো হেরা লেহাফড়া করতাছে। ইলা (মাহবুব) লগে থাকলে আমরার আর চিন্তা নাই।’ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাফর ইকবাল জুয়েল বলেন, মাহবুব ভাই এ প্রজন্মের কাছে একটি মডেল। যারা তাঁর কাছে শিখতে পারে শুধু অর্থ আর উচ্চ শিক্ষা নয়, সমাজের জন্য কিছু করার জন্য প্রয়োজন্য একটি দরদী মন, যার বড় অভাব আজকের সমাজে’।
প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষা ও প্রতিবন্ধী নারীদের কর্মসংস্থানে কাজ করার জন্য ২০১৮ সালে কিশোরগঞ্জ জেলায় ‘সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ হিসাবে জেলা সমাজসেবা অফিস তাঁকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এ বিষয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাহবুব প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণে কাজ করে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করছে।’ এ ছাড়া তাঁর সৃজনশীল লিখায় সমাজের অবহেলিত মানুষের অধিকারের কথা ফুটে ওঠে’।