ভোটের রাজনীতিতে গোটা দেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। বিরোধী দল গুলো অভিযোগ তুললেও নৌকা প্রতীকের সিংহভাগই প্রার্থী নির্বাচিত হচ্ছেন অনায়াসে। এর মধ্যেই লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ ছেড়ে কয়েকজন নেতার জাতীয় পার্টিতে যোগদান নিয়ে তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য।
বাংলাদেশে নানা সময় ক্ষমতাসীন দলে যোগদানের প্রবণতা থাকলেও উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা লালমনিরহাটে এর উল্টো চিত্র কেন, এ নিয়ে লালমনিরহাট জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়।
রাজনৈতিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজনৈতিক দল পাল্টানোর পেছনে আদর্শ নয়, কাজ করেছে মনোনয়ন পাওয়ার আকাক্সক্ষা। কেউ পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হতে চান। কেউ বা প্রার্থী হতে চান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে।
গত কয়েদিনে যুবলীগের সাবেক নেতা ওয়াহেদুল হাসান সেনা, কুলাঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দীন, খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জুলফিকার আলী বুলু ও লালমনিরহাট জেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম বসুনিয়াসহ ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতা জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
সম্প্রতি লালমনিরহাট সফরে যাওয়া সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের হাতে ফুল দিয়ে তারা দল পাল্টান।
ওয়াহেদুল হাসান সেনা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, তখন তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
২০০২ সালে আসেন যুবলীগে। ২০১১ সালে লালমনিরহাট পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। এবার তিনি মেয়র পদে প্রার্থী হতে চাইছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ মনোনয়ন পাওয়া যাবে না বলে চলে গেলেন জাতীয় পার্টিতে। এ ব্যাপারে তিনি জেলা জাপার শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সাথে জাপা থেকে একমাত্র তাকেই মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষনা করে নেন। তাই এবার নৌকার বিরুদ্ধে লাঙ্গল নিয়ে দাঁড়াবেন তিনি।
অপরদিকে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খুনিয়াগাছ থেকে নৌকা প্রতীকে ভোট করতে চেয়েছিলেন আ'লীগ নেতা জুলফিকার আলী বুলু। পরে আ'লীগ থেকে তাকে মনোনয়ন না দেয়ায় পরে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং নৌকার প্রার্থীর কাছে হেরে যান মাত্র ২০০ ভোটের ব্যবধানে। তাই তিনি জাপাতে যোগ দিয়ে ওই ইউনিয়ন থেকে লাঙ্গল প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করবেন বলে জানান এবং নির্বাচনে নির্বাচিত হবেন বলেও শতভাগ নিশ্চয়তা দেন।
জুলফিকার আলী বুলু বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু দল থেকে কখনই তেমন কোনো মূল্যায়ন পাইনি। তাই এবার বাধ্য হয়েইে জাতীয় পার্টিতে আসতে হলো। সব ঠিক ঠাক থাকলে আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবেন তিনি।
দল পাল্টানো আরেক নেতা মাহতাব উদ্দীন বলেন, ‘রাজনীতি করি, কিন্তু আমরা কোনো মূল্যায়ন পাই না। যা কিছু আসে, তা সবকিছু বড় নেতাদের হাতেই শেষ। আমরা যে এলাকায় থাকি মানুষের সাথে সব সময় ওঠাবসা মিলে মিশে থাকতে হয়। মানুষেরও তো কিছু চাহিদা আছে। কিন্তু আমরা তা মেটাতে পারি না।
‘সবসময় কথা শুনতে হয় স্থানীয়দের মুখে। তাই দলের সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ায় জাতীয় পার্টিতে যোগদান করি। আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তাই তিনি সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।
৪ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বাসভবনে এক অনুষ্ঠানে দলে যোগ দেন লালমনিরহাট জেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম বসুনীয়া। তিনি সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাপা থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চান।
গত নির্বাচনেও বসুনিয়া দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতীক তুলে দেয় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা স্বপনের হাতে। তিনি ভোটে জেতেনও। আগামী নির্বাচনেও নির্বাচনে তিনিই দলের প্রার্থী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে বসুনিয়া দলই পাল্টে ফেললেন।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে দল আমাকে মূল্যায়ন করেনি। সামনের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করব।
শুধু আ'লীগ থেকে জাপাতে যোগ দিচ্ছে তা নয়, বিএনপি থেকেও জাপাতে যোগদানে হিরিক পরে গেছে। কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টিতে আসেন মহেন্দ্রনগর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক যুবদল নেতা ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুল আশেকিন রতন। তার উদ্দেশ্যও আগামী ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে ভোটে দাঁড়ানো।
আশেকিন রতন বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনে দল যখন হাল ছাড়া তখন তিনি মহেন্দ্রনগর ইউনিয়ন বিএনপিকে সংগঠিত করে ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু তার সঠিক মূল্যায়ন তিনি পাননি। জাতীয় পার্টি আমাকে মূল্যায়ন করবে বলে কথা দিয়েছে এবং মহেন্দ্রনগর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাপা থেকে তাকেই প্রার্থী ঘোষনা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে নেতাদের জাতীয় পার্টিতে যোগদানে উৎফুল্ল জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক এস কে খাজা ময়নুদ্দিন বলেন, ‘অতীতের তুলনায় লালমনিরহাট জেলা জাতীয় পার্টি অনেক সুসংগঠিত। বর্তমান সরকারের একনায়কত›ের দেশের মানুষ আজ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও আজ মুক্তি চায়। তারাও জানে জাতীয় পার্টিই ভবিষ্যৎ। তাই ক্ষমতাসীন দল ছেড়ে শত শত নেতাকর্মী আমাদের দলে এসেছেন।
লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি সিরাজুল হক বলেন, ‘আমি তাদের যোগদানের বিষয়টি শুনেছি। তবে এখানে মন্তব্য করার কিছু নাই। এতে দলের কোনো ক্ষতি হবে না বলে আমি মনে করি। অনেকে চলে গেলেও আমাদের দলেও প্রায় প্রতিদিন অনেকে আওয়ামী লীগেও যোগদান করছে, আগামীতেও করবে।