পদ্মামুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন সহযোগী আশ্বাস দিলেও ২০১২ সালের ২৮ জুন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।
পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের দেয়া কঠিন শর্তে রাজি না হয়ে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধান মন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ২০১৫ সালে সেতুটির কাজ উদ্বোধন এবং ২০১৭ সালে নদীর বুকে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান স্থাপিত করেন। নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে দেশের সব চেয়ে বৃহৎ পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় সমপ্তি হওয়ায় এটি ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নৌ-পথের নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হলো। বিজয়ের মাসের সর্বশেষ পদ্মা সেতুর স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে যেন এটাই প্রমাণ করলো আরেকটি বিজয় লাভ করলো বাংলাদেশ।
পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু এটি। পদ্মা নদী উপর দিয়ে নির্মাণ হওয়ায় এ সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। এ সেতুটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট ৯১৮ হেক্টর জমিতে স্থাপিত এ সেতুটি ২ স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রক্ষ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতুটিতে ৪১টি স্প্যান বসানোর কাজ ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সমাপ্তি হয়েছে। তবে অনেক কাঠকড়, ঘাত-প্রতিঘাত, গুজব, আরও কত বাধা পেরিয়ে দৃশ্যমান হলো ৬ দশমিক ১৫০ কিলোমিটারের দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশামিক ১০ মিটার প্রস্থ নির্মিত সেতুটি। সরকার ২০২০ সালের শেষ দিকে এটি যানবাহন চলাচলের উপযোগী হওয়ার কথা ২০১৯ সালের শেষ দিকে বললেও, পদ্মা সেতুর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মন্তব্যে কলেন, এ ব্রিজ দিয়ে যানবাহন চলাচলের উপযোগী হতে প্রায় ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে একটু দেরী হলেও সেতুটির মাধ্যমে নৌ-পথের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ।
২০১৭ সালের প্রথম নদীর বুকে স্প্যান বসানো শুরু হলেও ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ ৪১ নম্বর স্প্যানটি বসানো শেষ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মনে করছেন অচিরেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে যাচ্ছি,এ জন্য প্রাধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষাজ্ঞরা বরছেন,“বিজয়ের মাসে আর একটি বিজয় হচ্ছে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো বসানোর মধ্যদিয়ে।” দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত আকাঙ্কার বিষয় ছিল এ পদ্মা সেতু, সেই সেতুরটির শেষ স্প্যানটি ডিসেম্বর বসানো মধ্যদিয়ে পুরোপুরি সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু। দুই পাড়ের নামা-উঠার অন্যান্য কাজগুলো শেষ হলেই সেতুটি চালু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর। সেতুটি চালু হলেই দক্ষিণ-উত্তরবঙ্গে শিল্প-কারখানা বাড়বে আর এতে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কর্মস্থান আরও বৃদ্ধি পাবে এর মাধ্যমেই দৃশ্যমান হলো ৬ দশামিক ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্ম সেতটিু। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সেতুটির কাজ শুরু হলেও এর এক বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চায়না রেলয়েল গ্রুপ লিমিটেড এর আওতাধীন চায়না মেজর ব্রীজ নামক একটি কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। তবে এ সেতুটির ব্যয় দরা হয় ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এসব ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভুমি অধিগ্রহণ, পূর্ণবাসন,পরিবেশ ও বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ-বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মানে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করতে সেতু কর্তৃপক্ষের।
তবে খুব দ্রুতসময়ের মধ্যেই পদ্মা সেতুর স্প্যানগুলো বসানো হয় যেমন- ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়।
২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিয়ারের ওপর দ্বিতীয় স্প্যান ৭বি সুপার স্ট্রকচার বসানো হয়। প্রথম বসানোর প্রায় চার মাস পর জাজিরার নাওডোবা প্রান্তে তিন হাজার ১৫০ টন ধারণ ক্ষমতার এ স্প্যান বসানো হয়। একই বছর জাজিরা প্রান্তের তীরের ষষ্ঠ প্যান বসানো হয়।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিয়ারের ওপর বসে তৃতীয় স্প্যানের বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়।
২০১৭ সালের ১৩ মে ৪০ ও ৪১ নম্বর পিয়ারের ওপর চতুর্থ স্প্যান বসানো হয়।
২০১৭ সালের ২৯ জুন সেতুটির পঞ্চম স্প্যান বসানো হয়েছিল শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায়। এ সময় ঐ এলাকার মানুষ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে।
২০১৮ সালে মাওয়া প্রান্তে ৪ ও ৫ নম্বর পিয়ারের ওপর বসে সপ্তম স্প্যানটি। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জন সাধরনের মাঝে নানান ধরণের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৯ সালের ২০ ফের্রুয়ারি জাজিরা প্রান্তে ৩৫ ও ৩৬ নম্বর পিয়ারের ওপর অষ্টম স্প্যান একই বছরের ২২ মার্চ সেতুটির ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পিয়ারের ওপর বসে নবম স্প্যান, ১০ এপ্রিল মাওয়া প্রান্তে ১৩ ও ১৪ নম্বর পিয়ারের দশম স্প্যান, ২৩ এপ্রিল শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৩ ও ৩৪ নম্বর পিয়ারের ১১তম স্প্যান, ১৭ মে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝামাঝি স্থানে ২০ ও ২১ নম্বর পিয়ারের ওপর বসানো হয় ১২তম স্প্যান, ২৫ মে ১৪ ও ১৫ নম্বর পিয়ারের ওপর ৩বি এর ১৩তম স্প্যান, ২৯ জুন ১৪তম স্প্যান, ২২ অেেক্টাবর জাজিরা প্রান্তে ২৪ ও ২৫ নম্বর পিয়ারের ওপর সেতুটির ১৫তম স্প্যান, ২৭ নভেম্বর মাওয়া প্রান্তে ১৬ ও ১৭ পিয়ারের ওপর ১৬তম স্প্যান, ৫ ডিসেম্বর পিয়ার ২২-২৩ এর ওপর মূল সেতুর ১৭তম স্প্যান, ১১ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১৮তম স্প্যান, ১৮ ডিসেম্বর ১৯তম স্প্যান, ৩১ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ১৮ ও ১৯ নম্বর পিলালের উপরে ২০তম স্প্যান বসানো হয়। তবে পদ্মা সেতুটির উপর ধূসর ‘৩-এফ’ নম্বরের স্প্যানটি খুঁটির উপরেই বসানো হয়েছে।
২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩২-৩৩ নস্বর পিলারের উপর বসানো হয় ২১তম স্প্যান, একই বছর ২৩ জানুয়ারি মাওয়া প্রান্তের ৫ ও ৬ নম্বর পিলারের উপর ২২তম স্প্যান ও ২ ফের্রুয়ারি ২৩ তম স্প্যান, ১১ ফের্রুয়ারি ২৪তম স্প্যান ও ২১ ফের্রুয়ারি ২৫তম স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ মার্চ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রাৗেল্প ২৮ ও ২৯ নম্বর পিলারের উপর ২৬তম স্প্যান বসানো হয়। একই বছর ২০ এপ্রিল ২৭ ও ২৮ পিয়ারের উপর ২৭তম স্প্যান ও ১১ এপ্রিল জাজিরা প্রান্তে বসানো হয় ২৮ তম স্প্যান। ঐ বছরই ৪ মে মাওয়া ১৯ ও ২০ তম পিয়ারের উপর ‘৪এ’ আইডি নম্বরে সেতুর ২৯ তম স্প্যান বসানো হয়েছিল। জাজিরায় ২৬ ও ২৭ পিয়ারের উপর ৩০ মে সেতুর ৩০ তম স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ জুন শরীয়তপুরের জাজিরায় ৫-এ স্প্যানে ২৫-২৬ পিলারের উপর বসানো হয় ৩১তম স্প্যান। ১১ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ৪ ও ৫ নং পিলারের উপর বসানো হয় সেতুর ৩২তম স্প্যানটি, ৩৩তম স্প্যানটি ২০ অক্টোবর ও ২৫ অক্টোবর সেতুর মাওয়া প্রান্তে ৭ ও ৮ নং উপর স্প্যান ২-এ তে ৩৪তম স্প্যানটি বসানো হয়। ৩১ অক্টোবর ৭ ও ৮ নং পিলারের উপর সেতুর মাওয়া প্রান্তে স্প্যান ২-বিতে ৩৫তম স্প্যান বসানো হয়। ৬ নভেম্বর মাওয়ায় ২-৩ নং পিলারের উপর ৩৬তম স্প্যান,১৩ নভেম্বর ৩৭তম স্প্যান ‘২-সি’ মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ৯ ও ১০ নং পিলারের ওপর, ২১ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ১ ও ২ নং পিলারের ওপর ৩৮তম স্প্যান, ২৭ নভেম্বর ৩৯তম স্প্যানটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ১০ ও ১১ নং পিলারের ওপর ‘টু-ডি’ স্প্যানটি বসানো হয়। ২০২০‘র ৪ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ৪০তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় সেতুর ৬ হাজার মিটার এবং ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নং পিলারে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। পদ্মা বহুমুখী সেতুর সম্পূর্ণ নকশা এইসিওএমের নের্তৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করেন। বর্তমানে পদ্মা সেতুর রোড়স্ল্যাব ও রেলস্ল্যাব বসানোর কাজ খুব দ্রুত চলছে। এ কাজ ও অন্যান্য ছোট-খাট কাজগুলো শেষ হলেই খুলে দেয়া হবে সেতু।