রাজশাহীতে ইংরেজি বর্ষবরণ উদযাপনে অপসংস্কৃতি পালনকালে মদ্যপান করে তার বিষক্রিয়ায় রোববার (৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রদল নেতাসহ মোট ছয় যুবকের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। এর আগে গত শুক্রবার দিবাগত গভীর রাত থেকে শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। এরা হচ্ছে- বিএনপি’র জেলা ছাত্রদল কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রাজশাহী মহানগরীর হোসনীগঞ্জ এলাকার আইনুল ইসলামের ছেলে ফয়সাল হোসেন (২৮), লক্ষীপুর ভাটাপাড়া বাকির মোড় এলাকার উত্তমের ছেলে সাগর (২৫), হেতমখাঁ এলাকার মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে তুহিন (২৬), কাদিরগঞ্জ এলাকার সেলিম আহমেদের ছেলে মুন আহম্মেদ (১৮) ও জেলার বাগমারা উপজেলার শান্তাপাড়া এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে সজল (২৫)।
এছাড়াও একইভাবে বর্ষবরণ উদযাপন করতে গিয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় মদ্যপানের পর বিষক্রিয়ায় সঙ্কটাপন্ন হয়ে শনিবার (২ ডিসেম্বর) রাত ১০টা পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ২৮ যুবক। যাদেরকে হাসপাতালের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডসহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একই আলামতে ভর্তিকৃতদের মধ্যে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রায় ২০জনের পরিচয় গোপন করতে ভিন্ন রোগের বর্ণনা খাতায় উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করার সর্তে রামেক হাসপাতালের কর্তব্যরত একাধিক স্টাফ প্রতিবেদককে জানান, পরিচয় গোপনকারী এসব রোগীদের পরিবার বিত্তবান ও প্রভাবশালী। সামাজিকভাবে সম্মান ক্ষুন্নের ভয়ে পরিবারের পক্ষ থেকেই মূলত বিষয়টি গোপন রাখার ব্যবস্থা করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, চিকিৎসাধীন এসব রোগীরা সকলেই কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয় পড়-য়া। তবে ভর্তিকৃতদের মধ্যে কয়েকজনের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ায় তাদের অভিভাবকরা নিজ দায়িত্বে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন।
রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরা হচ্ছে- মহানগরীর হেতমখাঁ এলাকার মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে তুহিন (২৬) একই এলাকার হাবিবের ছেলে কলপ (২২), হোসনিগঞ্জ এলাকার শিশির (২৪), তন্ময় (২৩) ও অর্নব (২৫), উপশহর নিউমার্কেট এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে বিশাল (১৮) এবং বাগমারা উপজেলার নগরআলী গ্রামের সুজন আলী (২৬)। তবে হাসপাতালে ভর্তিকালে এবং ভর্তির পর আরো কয়েকজনের শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নগরীর বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করার কথা বলে রোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে অর্নবও একজন। তার শারীরিক পরিস্থিতি খুবই সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় শনিবার দুপুরে আইসিইউ ওয়ার্ডে হস্তান্তরের নির্দেশনা দেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. মো. দেলোয়ার।
তবে অর্নবসহ সঙ্কটাপন্ন অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে তাদের পরিবার নিজ দায়িত্বে বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করানোর কথা বলে সরকারী এই হাসপাতাল থেকে অন্যত্র নিয়ে গেছে বলেও নিশ্চিত করেছে ওই সূত্র।
এদিকে নগরীর হোসনিগঞ্জ এলাকায় ঘটে যাওয়া মদ্যপানের ঘটনায় অনুসন্ধানকালে স্থানীয়রা জানান, ইংরেজি বর্ষবরণ আনন্দঘনভাবে উদযাপন করতেই আরও কিছু বন্ধুদের সংগে তারা রাজশাহী ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংঘের (শিমুলতলা ক্লাব) কক্ষে মদ্যপান করে। আর তাদের মাঝে শিমুলতলা ক্লাবের কথিত সেক্রেটারী রাকিবুল ইসলাম রাকিব ওরুফে আংকেল মদ পরিবেশন করেছিল বলেও জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক গণ্যমান্য ব্যক্তি।
তারা জানান, শিমুলতলা ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটির কার্যালয়ে অজ্ঞাত কারণে অনুপস্থিত। যার সুযোগে সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে সেখানে বখাটেদের নিয়ে আড্ডা দেন রাকিবুল ইসলাম রাকিব ওরুফে আংকেল। যেখানে নিয়মিত জুয়া খেলা পরিচালনা ও মাদকদ্রব্য সেবনসহ অসামাজিক বিভিন্ন কার্যকলাপ হয়ে থাকে। এ বিষয়ে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডাইরী রয়েছে। আর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করা আছে ক্লাবের অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান সমাজ সেবা কার্যালয় কেও। মাঝে মধ্যেই প্রশাসনের অভিযানে এই ক্লাব থেকে মাদকাসক্তদের গ্রেফতার করারও ঘটনা রয়েছে।
ঘটনার সার্বিক বিষয়ে মহানগরীর রাজপাড়া থানার কর্মকর্তা ইনচার্জ (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার রাতের কোন একসময় মহানগরীর হোসনীগঞ্জ এলাকায় এরা মদ্যপান করে। এমন প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মদ্যপানের সেই স্থানসহ অন্যান্য বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। আর মদ্যপানের পর এদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যরা তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। মৃতদের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পর যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে বলেও জানান ওসি।
এ ঘটনায় রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আারএমপি) মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে শুক্রবার রাত থেকে বিভিন্ন সময়ে তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়। তারপর তারা ভোরের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। প্রচন্ড অ্যাসিডিটি ও বমি হওয়ার ফলে তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তবে তারা মদ্যপানের কারণেই বিষক্রিয়া হয়ে মারা গেছে বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন।