মাঘের শিশির ভেজা প্রভাতে প্রকৃতিতে যখন আমের মুকুল ফুটে জানান দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা ঠিক তখনই বাংলাদেশের ব্যাপক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে বসন্ত নির্বাসিত। চৈত্রের নির্মম ক্ষরায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শীতের প্রকোপে ঝরে গেছে সব পাতা গুল্ম। এ থেকে পরিত্রানের পথ খুঁজে পাচ্ছে না এ দলের নেতা-কর্মীরা। স্থানীয় পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রিয় নেতারা প্রায় সবাই আইনের শিকলে বন্দি। গ্রেফতারের ভয়ে রাজপথে দাড়িয়ে আন্দোলনের পথ খুঁজে পাচ্ছেনা তারা। নিজে ৮৬ মামলার আসামী হয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করছেন, বিএনপি’র প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে লক্ষাধিক মামলা রয়েছে। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে সময় চলে যাচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রাম করার কোন সুযোগ তাদের নেই। দলীয় কর্মসূচি ছাড়া সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করতে তারা পারছে না। চার দেওয়ালে বন্দি থেকে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ রক্ষার কিছু বলে বিএনপি নেতারা এখন তাদের অস্তিত্ত্বের জানান দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে বিএনপি’র সংকট যে এবারই প্রথম তা নয়। এর আগে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মারা যাবার পর এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর দলটি সংকটে পড়েছিলো। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও একটা বড় সংকট গেছে তাদের। তবে এবারের পরিস্থিতি খুবই জটিল। দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দূর্নীতির অভিযোগে কারাগারে গেলে দলের মাঝে নেতৃত্ব শূন্যতা অনুভব হতে থাকে। তাছাড়া দলের মধ্যে সেকেন্ডম্যান হিসেবে কিছু নেই। যাকে সেকেন্ডম্যান বলা হচ্ছে, তিনিও দৃশ্যমান নন। তিনিও ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে দোষী সাবস্ত হয়ে পলাতক অবস্থায় প্রবাস জীবন-যাপন করছেন। বিএনপি পরিবার কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল হওয়ায় দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে অপরাধী হিসেবে সাবস্থ্য হবার পরও বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত দলীয় চেয়ারম্যান। আর তারেক রহমানের মাঝে তেমন কোন রাজনৈতিক ক্যারিসমা দেখা যায় নি, যার মাধ্যমে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত রেখে কর্মসূচি বাস্তবায়িত করবেন। বরং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উইনিং ক্যান্ডিডিয়েটকে বাদ দিয়ে টাকা খেয়ে নতুন প্রার্থী দিয়েছেন। তিনি ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে মৌসুমী নেতাদের কদর করেন বেশী।
রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে সব দল সামরিক ব্যারাকে বা অস্বাভাবিক ভাবে জন্ম নিয়ে হুট করে জ¦লে উঠেছে, সে গুলো সময়ের ব্যবধানে স্বাভাবিক ভাবেই কর্মহীন হয়ে হারিয়ে গেছে। সাধারনত: তৃতীয় বিশে^র অনেক দেশে উচ্চাভিলাশী সেনা কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করে স্থায়ী ভাবে ক্ষমতায় থাকতে চান। এমন ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে ঘটছে। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দু’জনই সাময়িক সাশক হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেন। বিএনপি তার অন্যতম। আদর্শের মরিচিকাকে শানিত করে নয়, দলছুট ক্ষমতার ভাগিদার হবার জন্য এদলে নেতা-কর্মীরা জমায়েত হয়েছে। দলীয় শ্লোগান দিয়ে নিজের আখের গুটিয়ে কেটে পড়েছেন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। তবে বিএনপি বেশ কিছু চড়াই-উৎড়াই পার করে আসার কারনে সারা দেশব্যাপী তাদের বিপুল সমর্থক রয়েছে। ভোটের হিসেবে সেটা অনেক বড়। কিন্তু নেতাদের অদক্ষতা, সাংগঠনিক অযোগ্যতার কারনে বিএনপি এখন প্রতিদিনই তার সমর্থক গোষ্ঠী হারাচ্ছে।
নেতুত্ব শুন্য বিএনপি তার রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দূর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে। এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যা দলের কোন কাজে আসছে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার মত কোন কর্মসূচি তারা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বিএনপির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরিন যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিএনপি অনেক পিছিয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক গতিধারা কখন কোন দিকে যাচ্ছে, কি ভাবে দলকে এগিয়ে নিতে হবে, এসব নিয়ে তাদের থিংক ট্যাকরা কোনো ভাবনা চিন্তা না করারয় আজ তারা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। রাজনীতির নিছক কোনো দেশের অভ্যান্তরিক বিষয় নয়। রাজনৈতিক দলকে আঞ্চলিক ও বিশ^ রাজনীতি সঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে কৌশল নির্ধারন করতে হয়। যুক্ত রাষ্ট্রের নাইন ইলেভেনের পর বিশ^ রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে বা ভবিষ্যৎ ভাবগতি কেমন হবে, এটা বিএনপি’র থিংক ট্যাংক একেবারেই বুঝতে পারে নি। তাদের পূর্বানুমান ও ভুল প্রমান হয়েছে। দীর্ঘ দিনের মিত্রদের ব্যাপারে এবং তার বাইরেও ভুল জায়গায় বিএনপি মিত্রদের সন্ধান করেছে। এসব ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাবছিল ভয়াবহ রকমের যা এখনো আছে। তাই দেশের বাইরে বিএনপির মিত্র কমেছে।
এশিয়ার পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত গনচীন বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র হলেও, বিএনপি তাইওয়ানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে গনচীন বিএনপির দিগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। এর জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহনের উদ্যোগ নেয়নি বিএনপি। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সৌহাদ্য সম্পর্ক না রেখে মিজরাম, সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্যতাবাদী আন্দোলনের লোকজনকে পৃষ্ঠপোষক করলে ভারত কেন বিএনপিকে তার মিত্র ভাববে? এখন তো বিএনপির বৈদেশিক উইং তো পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। শমসের মোবিন চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রথম সারির নেতা হলেও তিনি এখন বিএনপি ছেড়ে নৌকায় উঠে নিরব রয়েছেন। বিএনপির বড় বন্ধু গনচীনের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাঠিয়ে তা আবার প্রত্যাহার করে দু:খ প্রকাশ করার কথা এখন বাজারে চাউর হয়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি জনগনের কথা বলার চেয়ে তাদের নেতা-কর্মীদের মুক্তি নিয়ে বেশী সোচ্চার হয়েছে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে তেমন জোরালো কোন কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি নেতৃত্ব। অন্যদিকে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ভোটার বিহীন নির্বাচন বলে ফলাফল প্রত্যাক্ষান করার পরও তারা বর্তমান সংসদে যোগ দিয়েছে। আবার সব উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে ভোটে অংশ নিয়ে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে চলেছেন অভ্যাহত ভাবে। নির্বাচনের প্রচারনার সময় বলছে, দলীয় নেতা-কর্মীদের গায়েবী মামলা, গ্রেফতার ও ঘরে ঘরে পুলিশি তল্যাশি চালাচ্ছে। তার পরও নির্বাচনে তারা কেন অংশ নিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। তাই সরকার এখন বলছে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, জয়ী হতে নয়।
বিএনপির বর্তমান করুন অবস্থার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের নির্যাতন নিপীরনের মাঝে বিএনপি যে এখনো ঐক্যবদ্ধ আছে এটাই অনেক বড়। দলে কোন দ্বিধা বিভক্তি নেই। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটানো হবে। বিরোধী দলে থাকলে রাজনীতিতে ত্যাগী আদর্শবাদী নেতা-কর্মী তৈরীর সুযোগ থাকে। কিন্তু বিএনপি এ পর্যন্ত তাদের নেতা-কর্মীদের তেমন ভাবে তৈরী করতে পারেনি। শুধু দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি নয়, জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন দাবি দেওয়া নিয়ে শুশৃঙ্খলভাবে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে বিএনপির ওপর কারো আস্থা থাকবে না। বিশাল জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ফলে আগামী দিনে যদি বিএনপি বেসিলারি নো পার্টি হয়ে যায় তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না।