উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বারখ্যাত পাবনার বেড়া উপজেলার কাজীরহাট ফেরিঘাট ১৪ বছর বন্ধ থাকার পর আগামীকাল (২৭/০২/২১) চালু হতে যাচ্ছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরি চলাচলের উদ্বোধন করবেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর থেকে চাপ ও ঝুঁকি কমাতে এবং মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সরকারের ১০ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বৃদ্ধি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ফেরি চালুর এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা জানান, ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই বন্যার কারণে কাজীরহাট-আরিচার মধ্যে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ফেরিঘাটটি মাঝে দুই-একদিনের জন্য চালু হলেও আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৪ বছর ধরে কাজীরহাট ফেরিঘাট বন্ধ থাকায় উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র নগরবাড়ীঘাট স্থবির হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পাবনা, নাটোরসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ঢাকার মধ্যে পণ্য পরিবহনে বেশি ব্যয় হচ্ছে। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা ফেরিঘাটটি চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পরিবহন নেতারা জানান, গুরুত্বপূর্ণ এই ফেরিঘাটটি দ্রুত চালু করার ব্যাপারে গত ১৪ বছরে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-আমলারা। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ও ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে তৎকালীন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান পাবনায় গিয়ে ফেরিঘাটটি চালু করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ছাড়াও বর্তমান সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রী বেড়া উপজেলার বাসিন্দা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার (পরিকল্পনামন্ত্রী) ও শামসুল হক টুকু (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) মন্ত্রী থাকাকালে ফেরিঘাট চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নৌ-পরিহন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কাজীরহাটে গিয়ে ফেরি চালুর তারিখ পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন। সবশেষে গত বছরের (২০২০) ২৭ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বেড়া উপজেলার নগরবাড়ীতে গিয়ে ফেরিঘাট চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বার বার প্রতিশ্রুতির পরেও ফেরিঘাটটি চালু না হওয়ায় পাবনাবাসীর হতাশা দিন দিন বেড়েই চলছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে আগামীকাল থেকে ফেরি চলাচল শুরু হতে যাওয়ায় খুশির আমেজ দেখা দিয়েছে দুই পারের মানুষের মধ্যে।
ফেরি চলাচলের জন্য ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি। এর মধ্যে কাজীরহাট থেকে আরিচা পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার নৌপথের ড্রেজিং শেষ করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানসহ এ দুই সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার কাজীরহাট ও আরিচায় গিয়ে ফেরি চলাচলের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে কাজীরহাট ও আরিচার মধ্যে পরীক্ষামূলক ফেরি চলাচলও করেছে। ইতিমধ্যেই কাজীরহাটে ও আরিচায় নির্মাণ করা হয়েছে দুটি ফেরিঘাট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে প্রথম অবস্থায় চারটি ফেরি চলাচল করবে। যানবাহন পারাপারের ওপর ভিত্তি করে আরও ফেরি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
বিআইডব্লুউটিএর (নগরবাড়ী-কাজীরহাট এলাকা) উপসহকারী প্রকৌশলী রবিউল আওয়াল বলেন, ‘২৭ ফেব্রুয়ারি ফেরি চলাচল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই আমরা যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছি।’
এদিকে কাজীরহাট-আরিচার মধ্যে ফেরি চালুর খবরে দুই পারের মানুষসহ ট্রাক শ্রমিকদের ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুশির আমেজ দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ী ও পরিবহন নেতারা জানান, একসময় উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল কাজীরহাট ফেরিঘাট। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরেও ওই ফেরিঘাটটি চালু ছিল। কারণ ঢাকায় যাতায়াতের জন্য পাবনা, নাটোরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে অতিরিক্ত ১৭৫ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। কিন্তু কাজীরহাট ফেরিঘাট হয়ে যাতায়াতে তা হয় না।
তিন থেকে চারজন ট্রাকচালক হিসাব দিয়ে জানান, যমুনা সেতুর তুলনায় কাজীরহাট-পাটুরিয়া নৌপথে ট্রিপ প্রতি প্রায় দুই থেকে তিন হাজার টাকা সাশ্রয় হয়। এ ছাড়া দূরপাল্লার ট্রাকচালকেরা ফেরিতে বিশ্রামের সুযোগ পায় যা বঙ্গবন্ধু সেতুতে সম্ভব নয়। এ কারণে ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকেরা ফরি চালু হওয়ার খবরে দারুণ খুশি।
বেড়ার করমজা হাটে ট্রাকে পেঁয়াজ ওঠানোর সময় কথা হয় ট্রাকচালক ইয়াসিন আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়্যা যাতায়াতে খরচ, ভোগান্তি দুইই বেশি। অথচ ফেরিতে কম খরচে আরামে যতায়াত করা যাবি। এতে ঢাকায় মালের দামও কমে যাবে।’
নগরবাড়ী শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি এ এম রফিকউল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রতিশ্রুতির পর অবশেষে ফেরি চালু হতে যাচ্ছে। ফেরি চালু হলে নগরবাড়ী ও কাজীরহাটের ব্যবসায়িক স্থবিরতা কেটে যাবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এজন্য সবাই এখন খুশি।’