সময়টা এখন বাংলাদেশের। উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুতই ছুটে চলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার রজতজয়ন্ত্রী পালনের প্রাক্কালে সবাইকে আপ্লুত করে খবর এলো-বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যোগ দেওয়ার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘের এ ঘোষনায় বাঙ্গালি জাতি গর্বিত। ১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরনে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসি (ইউএস-সিডিপি)’র সব শর্ত পুরন করে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী কোন দেশ পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদন্ড পূরনে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরনের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। সিপিডি তিনটি সুচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরনের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। আশার কথা তিনটি সুচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে অত্যান্ত সফলতার সাথে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮২৭ ডলার। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার বলে দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। অর্থ্যাৎ মানদন্ডের চেয়ে এক দশমিক সাত গুন বেশি। মানবসম্পদ সুচকে নির্ধারিত মানদন্ড ৬৬ এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক চার। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতার সুচকে উত্তরনের মানদন্ড নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান ২৭।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম, প্রতিভা দিপ্ত সৃষ্টিশীলতা ও অভূতপূর্ব সংগঠনিক দক্ষতার কারনে আজ বন্যা, ক্ষরা, ঝড় সহ প্রাকৃতিক দূর্যোগের বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ জন্য তাকে অভিনন্দন জানাই। সাথে প্রত্যাশা করি এ উন্নয়ন শুধু আত্ম তৃপ্তির না হয়ে টেকসই হোক। এজন্য যথাযথ প্রস্তুতিও প্রয়োজন। তবে সিডিপির প্রবিধান অনুযায়ী উত্তরনের সুপারিশ পাবার পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল হিসেবে ভোগ করতে পারবে।
আমরা মনে করি এ সময়ের মধ্যে আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে সক্ষম হব। কারন বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দানাদার খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমান ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। বাংলাদেশ বিশে^র ধান উৎপাদানকারী দেশের মধ্যে তৃতীয়। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ন, অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বিদ্যুৎতের স্থাপিত ক্ষমতা ছিল মাত্র ৫ হাজার ২৭১ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নিত হয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নিত হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ২০০৯-১০ বছরের ৬৯ দশমিক ৬১ বছর থেকে বেড়ে ২০১৯-২০ সালে দাড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর। ২০০৯-১০ বছরের তুলনায় ৫ বছর বয়সি শিুশুর মৃত্যুর হার অর্ধেক কমে দাড়িয়েছে প্রতি হাজারে ২৮। মাতৃ মৃত্যুর হার কমে দাড়িয়েছে লাখে ১৬৫ জন। যা ২০০৯-১০ এ ছিল ২৮০ জন। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌছে গেছে ব্রডব্যান্ড সুবিধা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লাবিক পরিবর্তন সুচিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে দেশের ভাসমান মানব গোষ্ঠীকে স্থায়ী-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। বাসস্থানের নিরাপত্তার কারনে এখন তারা তাদের নিজেদের জন্য আয়ের পথ প্রশস্ত করতে পারবেন। অসহায় মানুষদের বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ নানা ভাতা দিয়ে বেঁচে থাকার পথ প্রশস্ত করছে শেখ হাসিনা সরকার। বাংলাদেশের নারীরা আজ স্বাবলম্বী। জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৫৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০ তম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম। অন্যদিকে সল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ উত্তরনের ফলে বর্হিবিশে^ বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশালাী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই এ অর্জন টেকসই ও সুসংহত করেতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিনত হওয়ার ক্ষেত্রে এলডিসি থেকে উত্তরন আমাদের জন্য একটি বিশেষ ধাপ। ইতোমধ্যে আমরা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহন করেছি। টেকসই উত্তরনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল এতে অন্তভুক্ত করা হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্নফুলি নদী তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিুদ্যৎ প্রকল্প, মহেশখালী মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু এবছর বা আগামী বছর চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পাক ও আইটি ভিলেজ নির্মানের কাজ এগিয়ে চলেছে। এসব বাস্তবায়ন হলে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং দেশের অর্থনীতিতে আরো গতি সঞ্চার হবে।
আমরা মনে করি বাংলাদেশের জনগন দেশকে এগিয়ে নেবে অভিষ্ট লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তবে মনে রাখতে হবে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ভারত ও চীন ছাড়াও উন্নত দেশগুলোতে যে বানিজ্য সুবিধা বাংলাদেশ পাচ্ছে, সেটি আর পাবে না। তিন বছর পর অর্থ্যাৎ ২০২৯ সালের পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) এ শুল্ক মুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে, এডিসি হিসেবে মেধাস্বত্ত, পের্টেন্ট, তথ্য প্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীলে উত্তরনের পর বিনামূল্যে এসব প্রযুক্তি বা সেবা পাওয়া যাবে না। ফার্মাসিউটিকাল খাতে এনডিসি হিসাবে বাংলাদেশ পেটেন্ট লাইসেন্স ছাড়াই উৎপাদন করতে পারে। ২০৩৩ সালের পর এই সুবিধা আর থাকবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু তহবিল থেকে বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছে। ২০২৬ সালের পর থেকে এসব অনুদান বা সহায়তা মিলবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব সম্পদ উন্নয়নে জাতিসংঘ সহ বিভিন্নদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষ সহায়তা পাওয়া যায়। এসব সহায়তা ২০২৬ সালের পর আর পাওয়া যাবেনা। এনজিও গুলো বর্তমানে যেসব খাতে অনুদান পাচ্ছে, তা আর পাবে না। এমনকি হিসাবে যে রেয়াতি সুদে অর্থ্যাৎ সহজ শর্তে বিশ^ ব্যাংক, এডিবি থেকে ঋণ মিলছে সেটাও আর মিলবে না। তাদের ঋনের সুদের হার বেড়ে যাবে। এছাড়া এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। রপ্তানী খাতে দিচ্ছে নানা রকম প্রনোদনা সুবিধা। এমন কী রেমিটেন্স আয়েও নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে এসব ভর্তুকি ও প্রনোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আছে। তৈরি পোষাক খাতে ঝুঁকি গড়বে বলা হলেও আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক দিয়েই পোষাক রপ্তানী করি।
অন্যদিকে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বর্হিবিশে^ বাংলাদেশ মর্যাদা বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা বাড়বে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে। আর বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়বে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং বিভিন্ন খাতে সরকার বিনিয়োগ বাড়তে পারবে। বানিজ্য বাড়বে বাংলাদেশের আর কারখানা ও শ্রমিকের দক্ষতা কারনে উৎপাদানশীলতা বাড়বে। রপ্তানির ক্ষেত্রে দরকষাকষির সুযোগ বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা বহুলাংশে বাড়বে।
গত শতাব্দির ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তর দশকের সুচনা কালে বিশে^র পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সামনে এগিয়ে নিতে সল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশ হিসেবে শ্রেণী বিন্যাস করে জাতিসংঘ। সেই থেকে সল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নিত হবার প্রতিযোগিতা চলছে। মূলত: বিশে^র সব দেশই উন্নয়নশীল দেশ। উন্নত দেশগুলো নিজেদের অবস্থান স্থিতিশীল রাখতে বা তার চেয়ে উন্নত করতে সব সময় কাজ করছে। আর স্বল্পোন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশ হতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। বাংলাদেশ সল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসায় আত্মতুষ্টির কিছু সেই। বরং তা অর্জন করে আত্ম মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশে^র দরবারে মাথা উঁচু করে বাড়াতে পারলেই সার্থকতা। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার সুযোগ্য কন্যা আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে যথাযথ নের্তৃত্ব দিচ্ছেন। আশা করা যায় আমরা তা অর্জনে সফল হবো ইনশাআল্লাহ।