দেশব্যাপী চলমান করোনা টিকাদান কার্যক্রমে সাড়া দিয়ে মঙ্গলবার (২মার্চ) পর্যন্ত ৪৫ লাখ ৩০ হাজার ৮২০ জন নিবন্ধন করেছেন। এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৩৩ লাখ ৪১ হাজার ৫০৫ জন। ২ মার্চ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় এক লাখ ১৪ হাজার ৬৮০ জন টিকা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৬৮ হাজার ৫৩৯ ও নারী ৪৬ হাজার ১৪১ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকায় ১০ লাখ ২৭ হাজার ৮১ জন, ময়মনসিংহে এক লাখ ৪২ হাজার ৮৯৮ জন, চট্টগ্রামে সাত লাখ ২৬ হাজার ৬৯ জন, রাজশাহীতে তিন লাখ ৬৬ হাজার ২২৯ জন, রংপুরে তিন লাখ তিন হাজার ৭৮০ জন, খুলনায় চার লাখ ১৭ হাজার ৪৭৬ জন, বরিশালে এক লাখ ৫৬ হাজার ২৩৭ জন এবং সিলেট বিভাগে দুই লাখ ১৭ হাজার ৩৩৫ জন করোনা টিকা নিয়েছেন।
মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ সনটি সকলের জীবনেই বিষাক্ত হয়েছে। একুশ সনের স্বস্তির বার্তা যে করোনার টিকা আবিষ্কার হয়েছে। সফল হয়েছে বলা যায় টিকা দান কার্যক্রম। দেশজুড়ে টিকাদান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সকে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এসময় টিকাদান ব্যবস্থাপনার ‘সুরক্ষা’প্ল্যাটফর্মের মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা হয়। যারা টিকা নিতে চান তাদের সবাইকেই এই অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। ৪০ বছর বা তদ্ধুর্ধ যে কেউ টিকা নিতে পারবে। সারাদেশের ১০০৫ কেন্দ্রে একযোগে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। ইতিমধ্যে টিকা নিয়েছে সরকারের দায়িত্বশীল অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চ পদস্থ কর্মর্কতা।
করোনা ভাইরাস সনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সকলের মাঝে টিকা নিয়ে শুরু হয় সংশয়। টিকা আদৌ আবিষ্কার হবে কি না, কবে পাওয়া যাবে, কিভাবে পাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আবিষ্কারের পর টিকা নেওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন সংশয়। সংশয়টা চতুর্মূখী বলেই মনে হয় আমার কাছে। টিকা নিলে পাশ্বপ্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে, টিকা সহজলভ্য হবে কি না, টিকার সুষম বন্টন হবে কি না, হলে কিভাবে হবে ইত্যাদি। ইতিমধ্যে অনেকে টিকা নিবে না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে হয়ত।
বাঙালী কৌতুহলপ্রবণ জাতি। তাই কৌতুহল আছে, থাকবেই। সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য সকলে সচেতন হোক এটা সকলেরই কাম্য। সচেতনতা সকলেরই থাকা দরকার তবে, অতি সচেতনতা কিন্তু কাজে আসে না। তাই সচেতনতার মাঝে অচেতনতার প্রবণতা আমাদের দূর করতে হবে। অসচেতন মানুষকে সচেতন করা যায় কিন্তু সচেতন যারা অসচেতন থাকে তাদের বোঝানো যায় না। সচেতন বা অচেতন যাই হোন না কেন টিকা নিতে সংশয় কাটাতে হবে। সংশয় কাটাতে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। যেভাবে সচেতনতার মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়েছে তেমনিভাবে সচেতনতার মাধ্যমে টিকার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একই অসুখে একই ঔষধ খেয়ে কিন্তু সকলের আরোগ্য হয় না। সকলের একই রকম সমস্যাও তৈরি হয় না। তাই টিকা দিয়ে যদি সকলের একই সমস্যা হতো তাহলে সেটা নিয়ে সংশয়ের কারণ ছিল। তাছাড়া সরকার তার ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে অরক্ষিত টিকা নিবেন না, এই বিষয়ে মনে হয় কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। টিকা শুধু বাংলাদেশে নয় অনেক দেশেই দেওয়া হচ্ছে। তাই টিকা দেওয়া নিয়ে কোন সংশয় থাকার যৌক্তিকতা আপাতত দেখছি না।
আসি প্রাপ্যতায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। শুরুতে ২৫ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার কথা হলেও এখন ৫০ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর আট সপ্তাহ পর আসছে আরো ৫০ লাখ ডোজ, তাও পুরো দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভ্যাকসিন মৈত্রীর আওতায় ভারত সরকার বাংলাদেশসহ বন্ধুপ্রতীম ৬ দেশকে টিকা উপহার দিয়েছে। বাংলাদেশকেই দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ডোজ। এবার উপহার হলেও পরবর্তীতে সব টিকা কিনে নিতে হবে। বাংলাদেশে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়বে ৫ ডলার (৪২৫ টাকা)। রাজধানীর যে পাঁচ হাসপাতালে টিকা দেওয়া হবে, তা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে টিকা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে বুথ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া টিকা প্রয়োগের পরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও কারো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছে হাসপাতালগুলো।
করোনা টিকার ডোজ নিতে হবে দুটি। প্রথম ডোজ নেওয়ার আট সপ্তাহ পর নিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ। প্রথম ডোজ বা দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর কিছু স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরকম কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় প্রতিটি টিকার ক্ষেত্রেই হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হলো হালকা মাথা ব্যথা বা শরীর ব্যথা, টিকা নেওয়ার স্থানে হালকা ফুলে যাওয়া বা লাল হয়ে যাওয়া, হালকা জ্বর এবং বমি বমি ভাব, শরীর হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, সন্ধিস্থলে ব্যথা। কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। তাছাড়া টিকা গ্রহণের পর ৩০ মিনিটি টিকাস্থলে থাকতে হবে বলে জানানো হয়েছে। হয়ত এই বার্তাটিতে অনেকে সংশয়ে পরছেন তবে
টিকা গ্রহণের আগ পর্যন্ত আপনি ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাবেন সেটাও ভাবতে হবে। করোনা আক্রান্ত হলে আপনি ও আপনার পরিবার কিংবা আপনার সংস্পর্শে যারা আসবেন তারাও ঝুঁকির আওতায় থাকবেন। টিকা আপনাকে আপনার কাছের মানুষদের ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করবে। টিকা গ্রহণের ফলে আপনার শরীরের প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যাবে। ফলে আপনি তখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন ।
আগে যেখানে যক্ষা হলে রক্ষা ছিল না এখন সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে ক্যান্সার কেও জয় করা সম্ভব হচ্ছে। টিকা আমাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিমুক্ত, সুস্থ ও নিরাপদ করেছে। কমিয়ে দিয়েছে মৃত্যুর হার। বিভিন্ন টিকা আবিকারের কারণে এখন শিশুমৃত্যুর হার কম। এককথায় টিকা আবিষ্কার আমাদের মাথাপিছু গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার টিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই আসুন টিকা নিয়ে আর সংশয় না করি। টিকা নিয়ে সংশয় দূর করি।
করোনাকালে সরকারি অনুদান চুরি, ভুয়া টেস্ট নিয়ে তুলকালামও হয়ে গেছে। সেসব কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি সরকারকে নিতে হবে। ভুয়া টিকায় বাজার সয়লাব হওয়া, বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে জালিয়াতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ ফলে এ নিয়ে এখনই শক্ত অবস্থান নিতে হবে৷ সমস্ত অব্যবস্থাপনা কাটিয়ে উঠে দ্রুতই বাংলাদেশে করোনার টিকার সুষম বন্টন করে সংশয় কাটাতে হবে। করোনা যেহেতু জাতীয় দুর্যোগ তাই জনগণ বিনামূল্যে টিকা পাচ্ছে কি না নজরদারি বাড়াতে হবে। সহজে যেন টিকা নিতে পারে সেই দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ সহজ ও সাবলীল ব্যবস্থা টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। জনগণের স্বস্তঃস্ফূত অংশগ্রহণ ও টিকা ব্যবস্থাপনায় সঠিক নিয়মই সফল করতে পারে টিকাদান কার্যক্রম। সকল সংশয় কাটিয়ে স্লোগান হতে পারে, “টিকা নেই সুস্থ থাকি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করি”।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট