আমলাতন্ত্রের শিকড় বহু যুগ থেকেই সুবিন্যস্ত, সম্প্রসারিত এবং এর ডালপালাও সুবিস্তৃত। যা ভোক্তভোগী ছাড়া বুঝা বাস্তবিকই দূরূহ। এক কথায় বলা যায় ক্ষমতা অপব্যবহারের (Misapropriation of power) এ যেন এক বিষফোঁড়ারই নামান্তর ও বেদনার প্রতিচ্ছবি। বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের আরও আগে এর গোড়াপত্তন ও সূত্রপাট ঘটে। পরাধীন বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এর ব্যাপক প্রসার এবং পাকিস্তানের ২৩ বছরে আমলাতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা (Structural Interlocking) দেশের মানুষকে নাভিশ্বাস ও হতভম্ব করে তোলে। যা স্বাধীকার আন্দোলনের পথকে সুগম করে তোলে।
বর্তমানে বিসিএস (BCS) ) পাকিস্তান আমলে ((CSP) ও বৃটিশ আমলে (ICS) ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস কর্মক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেতাব। যা শাসন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদা। এখান থেকে উচ্চপদে চাকরির গোড়াপত্তন বলে অনেকেই মনে করে থাকে। তন্মধ্যে বাংলাদেশে বিসিএস প্রশাসন, বিসিএস জুডিসিয়াল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ ক্যাডার, প্রকৌশল পদমর্যাদাসহ অন্যান্য বিভাগ ও সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদা। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সংগত কারণে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল অনেক গুণ বেশি। ইংরেজী শিখলে মুসলমানরা কাফের হয়ে যাবে এই ভ্রান্ত, অপপ্রচার ও মিথ্যা তকমা এর জন্য দায়ী বলেও অনেকই মনে করে থাকে। যদিও ইহা ছিল বৃটিশ ও হিন্দুদের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের অংশে বিশেষ। পরবর্তী সময় এই ষড়যন্ত্র ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে উত্তরণের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় মুসলীম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে এই মিথ্যা তকমা, ভ্রান্ত ধারণা ও ষড়যন্ত্র অনেকটা নির্বাসিত হয়ে থাকে। ফলে মুসলমানরা আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষায় অনেকাংশে এগিয়ে যায়। যার রয়েছে অজ¯্র নজির ও দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই সুযোগে হিন্দুরা চানক্য কৌশল কাজে লাগিয়েও বৃটিশদের সাথে ভাব বা সখ্যতা জমিয়ে আইসিএসসহ উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়ে যায়। তন্মধ্যে মুসলমানদের সংশ্লিষ্টতা একেবারে ছিল না তা বলা না গেলেও ইহা ছিল একেবারে নগন্য ও ঁহপড়ঁহঃধনষব। তখন মুসলমান কর্মজীবিরা বৃটিশ ও হিন্দুদের যাঁতাকলে পড়ে তাদের পায়রুবি করা ছাড়া কোনো উপায়ন্তর ছিল না। যাকে বলা যায়, জো হুকুম জাঁহাপনা, জি স্যার ও ইয়েস স্যারের নামান্তর। আর এই সুযোগে শাসন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে বৃটিশ ও হিন্দুরাই ভাগাভাগি করে দায়িত্ব পালন করে থাকে। বিশেষ করে এসডিও বা ঝউগ, ডিএম বা জেলা প্রশাসক, এসডিপিও, এসপি, সিভিল সার্জন, মুন্সেফ, জজ, জেলা জজসহ আরও উচ্চ পদে ওরাই দায়িত্ব পালন করে থাকে। ফলশ্রুতিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফলে (ঝঃৎঁপঃঁৎধষ ওহঃবৎষড়পশধরহম) সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে নিগ্রহ ও চরম দুঃখকষ্টে নিপতিত করে থাকে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে বৃটিশ ও হিন্দু আমলাদের সুগভীর ষড়যন্ত্রে মুসলমানদের কোনঠাসা ও ধাবিয়ে রাখার লক্ষ্যে হিন্দুদেরকে পরগনার জমিদার বানিয়ে মুসলমানদেরকে সেবাদাস ও আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ করে থাকে। জমিদারদের এহেন নির্যাতন নিয়ে রয়েছে অসংখ্য দৃষ্টান্ত ও ঐতিহাসিক দালিলিক প্রমান ও বিড়ম্বনা। যা পড়লে আজও গা শিহড়িয়ে ওঠার উপক্রম হয়ে থাকে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানিরা ২৩ বছর দেশটি শাসনকালে সেখানে আবার নতুন করে আমলাতন্ত্রের শিকড় বিস্তৃতি ঘটায়। শাসনের নামে শোষন, আমলাতন্ত্রের ভূত ও আমলাতন্ত্রের দেবতার আবির্ভাব হয়। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (ঈরারষ ঝবৎারপব ড়ভ চধশরংঃধহ) একচেটিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদিগকে নিয়োগ করে
বৈষম্যের সীমাহীন পরাকাষ্টায় নিপতিত হয়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) লোকদের যোগ্যতা থাকলেও তাদেরকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস তথা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে। তাতে পাকিস্তানিরা অধিকাংশ উচ্চ পদে সমাসীন হয়। তাতে ওরাই দেশের এসডিও, ডিসি, এসপি, জজ থেকে শুরু করে সচিব, চীফ সেক্রেটারী, প্রধান বিচারপতি, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনার, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও বিভাগে নিয়োগ লাভ করে।
এছাড়া পাকিস্তানের গোড়াতেই ছিল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কুহেলিকা। তখন সরকার ব্যবস্থাপনা আখ্যায়িত হত এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ চধশরংঃধহ বা পাকিস্তান সরকার। আর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে (বাংলাদেশ) বলা হত এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ বা পূর্ব পাকিস্তান সরকার। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ চধশরংঃধহ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এমনকি পাকিস্তানের ৫৬ ও ৬২ সালের সংবিধান (ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ) ও তাদের স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়। তাতেও পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি গোটা দেশটাকে আমলাতন্ত্রের কারখানা, একনায়কন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করে থাকে। এছাড়াও চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের দাবানল ও পাহাড় সৃষ্টি করে থাকে। তদোপরি সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সদর দপ্তরসহ নির্বাচন কমিশন, পুলিশ সদরসহ সব কয়টি প্রধান কার্যালয়ও ছিল পাকিস্তানে। এছাড়া পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন (চওউঈ) সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদর দফতরও ছিল পাকিস্তানে। তদোপরি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে জাতীয় সংসদ ভবন ও পাকিস্তানের রাজধানী ছিল যথাক্রমে করাচী, ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি।
সেই সময় পাকিস্তানের আমলারা বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে যেমন অশোভন আচরন করত তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের চাকরিজীবীদের সাথে দৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের সীমা পরিসীমা ছিল না। এ প্রসঙ্গে জানা যায়, একবার পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে (চওঅ) কর্মরত পূর্ব পাকিস্তানের এক চাকরীজীবিকে উক্ত অফিসের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মদ এনে দেয়ার হুকুম দিলে উক্ত কর্মকর্তা সবিনয়ে বলেছিলেন স্যার আমাকে যে কোন আদেশ দেন তা আমি পালন করব। তবে মদ এনে দিতে পারব না। এ কথা বলার সাথে সাথে উর্দুতে অকথ্য গালিগালাজ করে। প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করে হাত ভেঙ্গে দেয়। শুধু তাই নয় পরবর্তী সময় অসদাচরণের অভিযোগ এনে চাকুরি থেকে তাৎক্ষণিক (ঝঃধহফ জবধষরংব) করে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় এবং তৎস্বার্থে পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিকট অযৌক্তিক ও বেমানান গোপনীয় প্রতিবেদন (ঈড়হভরফবহঃধরষ জবঢ়ড়ৎঃ) হস্তান্তর করে থাকে। এমনিভাবে আরও অসংখ্য নিগ্রহ, হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক কাহিনী দৃশ্যপটে কম পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলাদের মধ্যে কোনো ব্যবধান ছিল না। সেই আমলাতন্ত্রের জটিলতা ও অন্যান্য সীমাহীন বৈষম্যের কোনো ব্যবধান ছিল না। সেই আমলাতন্ত্রের জটিলতা ও অন্যান্য সীমাহীন বৈষম্যের কারণেই তাদের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ২৩ বছরের যারপর নাই বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার ও আমলাতন্ত্রের বিভীষিকার দানা সম্প্রসারিত হয় ও ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের কবর রচিত হয় এবং এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয বা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে অলংকিত হয়।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আমাদের গর্ব ও অহংকার। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ও দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ আমাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযোদ্ধা ও আরও অনেকের ত্যাগ ও অবদানকে ভুলে যাওয়ার নহে। তাদের ত্যাগ ও অবদান চিরউজ্জ্বল, অম্লান, চিরভাস্বর ও অবিস্মনীয় হয়ে থাকবে। তদোপরি স্বাধীনতার যুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে এদেশের শ্রেণীপেশার লোকজন, সাধারণ জনগণ ও দেশমাতৃকার সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভুলে যাওয়ার নহে। তদোপরি বৃটিশের ১৯৬ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও দাজ্জাল পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের শোষন, নির্যাতন, ব্যভিচার, লুটপাট, পরাকাষ্টা, চক্ষুশূল, নৃশংসতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কখনও হৃদয় থেকে সরে যাওয়ার কথা নয়। যা বেদানবিধূর ও অশ্রুসিক্ত অমানবতার অম্লান ইতিহাস ও ডকুমেন্টারি দলিল (ঊারফবহপব) হিসেবে স্বীকৃত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য আজও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির মৌলিক অধিকার ও আমলাতান্ত্রিক রোষানল থেকে মুক্তি আসেনি। যদিও কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের ঘামে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। তাদের উপার্জিত অর্থেই সরকারী কর্মকর্তাদের আলীশান গাড়ী, বিলাসবহুল বাড়ী ও শীততাপের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যদিও প্রজাতন্ত্রের জনগণ তাদের কাছ থেকে যা পাওয়ার তাতো পায়েই না বরং অনেক সময় তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য, দুর্ব্যবহার, বেরসিকতা ও গলদগর্ম ব্যবহারের শিকার হতে হয়। তাই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মানুষের সাথে স্বাধীন দেশের মানুষের মতো সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। তাদের শ্রম, কষ্ট ও ঘামে ভেজা অক্লান্ত পরিশ্রমের অর্থ দিয়েই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। তাদের শ্রমের অর্থে খাজনা, ট্যাক্স দিয়েই আপনাদের গাড়ী, বাড়ী ও শীততাপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের যোগান দিতে হয়। তাদের অর্থে রাস্তাঘাট ও উন্নয়নের কাজ হয়। এছাড়া পাকিস্তানের আমলে ছিল, গভর্ণমেন্ট অব পাকিস্তান, গভর্নমেন্ট অব ইস্ট পাকিস্তান। এখানে আমলাদেরই প্রাধান্য ছিল। বাংলাদেশ আমলে এর বদলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বা এড়াবৎসবহঃ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয.
কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং তাদের কাছে প্রতিনিয়ত ন্যায্য কাজের জন্য গিয়েও ভোক্তভোগীদের হয়রানী অপরিসীম জ্বালা যন্ত্রণা পেয়ে নিগৃহ হয়ে আসতে হয়। যে জ্বালা মনে মানেনা, প্রাণে সহে না। যার ইয়াত্তা নেই। অনেক সময় স্বাধীন দেশের অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের হুংকার ও আচার আচরণ দেখে পাকিস্তানের দাজ্জালদের প্রতিচ্ছবি ও অমার্জনীয় দুর্ব্যবহার ভেসে ওঠে। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশের শাসন, প্রশাসনের চেয়ারে সমাসীন থাকলেও হাব ভাব দেখে ভাবতে হয় ওরা জনসেবার ধারে কাছেও নেই। যেন ইস্ট ইন্ডিয়া বেনিয়া ও পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী, একনায়ক ও স্বৈরশাসকের প্রেতাত্মা। যে কারণে প্রায় সময় ওদেরকে জবাবদিহীতার জন্য ও আদালত
স্বপ্রণোদিত হয়ে তলব করে থাকে। ওদের যেমন ন্যায়নীতি ও মানবতার দর্শন নেই, তেমনি ওদের হাবভাব দেখে অনেকেই মনে করে ওরা যেন ভিন্ন গ্রহের আজব জীব। এমনকি অনেক সময় ওরা সাধারণ স্বশিক্ষিত মানুষের সাথে উর্দু ও ইংরেজিতে তুই তোগারি করে কথা বলতেও দ্বিধা সংকোচ বোধ করেনি। ওদের এসব আচরণ দেখে অনেকেই তাদেরকে আমলাতন্ত্রের ভূত ও দেবতা বলতে কুণ্ঠাবোধ করে না। অনেকেই মনে করে ওরা দেশের মালিক ও প্রজাতন্ত্রের জনগণ তাদের সেবা দাস।
স্বাধীন বাংলাদেশে অহরহ পাকিস্তানী আমলের আমলাতন্ত্রের অনুরোপ স্পর্শকাতর, জটিল ও বিভীষিকা দৃশ্যপটে চলে আসে যা একটি স্বাধীন দেশের জনগণের জন্য দুর্দশাই নহে অশ্রু নিংড়ানো বেদনা ও দুঃখজনকও বলা চলে। চিঠিপত্রের কলামে প্রকাশিত একটি সূত্র থেকে জানা যায় একবার জেলা পর্যায়ের একটি অফিসে কলেজের জনৈক অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক একটি কাজের ব্যাপারে ৩ দিন অফিসে উক্ত কর্মকর্তাকে না পেয়ে ৪ দিনের মাথায় তার সাক্ষাৎ পায় এবং গল্প গুজবেরত থাকতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর উক্ত সহকারী অধ্যাপক সাহেব উক্ত কর্মকর্তাকে বলতেছিলেন ৩ দিন যথাসময়ে আপনার অফিসে এসে না পেয়ে ৪ দিনের মাথায় অবশেষে আপনার দেখা পেলাম। তাতে আমার কাজের যথেষ্ট সমস্যা হয়েছে। ইহা শুনে সেই কর্মকর্তা নাকি উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, আপনার কাছে কী আমার এর জবাব দিতে হবে চলে যান। আমি আপনার কথা শুনব না। যেখানে গেলে বিচার পান সেখানে যান। আমি কাহাকেও ভয় পাই না। আমি আপনার চাকরি করিনা। তারপর সহকারী অধ্যাপক সাহেব সেখান থেকে চলে আসেন। তারপর তিনি আক্ষেপ করে ঠিঠিপত্রের কলামে লেখেছিলেন, এই হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সেবকের নমুনা। যা কোনো মতেই বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমলাদের অশোভন আচরণও তীর্যকতার চেয়ে কম নহে। ওরাই আবার শাসন ও প্রশাসনের ধারক, বাহক ও চালিকা শক্তি।
পাকিস্তানের দাজ্জাল, হানাদার ও আমলাদের কবল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আজও আমলাতন্ত্র আমলাতন্ত্রের রোষানল, আমলাতন্ত্রের বাজিকর, আমলাতন্ত্রের জটিলতা (ঝঃৎঁপঃঁৎধষ ওহঃবৎষড়পশধরহম) ও আমলাতন্ত্রের বিষফোঁড়া থেকে যেমন দেশের মানুষের পরিত্রাণ ও মুক্তি আসেনি তেমনি এই আমলারাই স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদে পদে সরকারকে সমূহ চাপে ও বেকায়দায় রাখতে দ্বিধা সংকোচ ও কুণ্ঠাবোধ করছে না। ওদের কোনো দর্শন নেই। যে বা যাহারা ক্ষমতায় আসে ওরা তাদেরই পায়রুবি করতে তড়িত সিদ্ধহস্ত। এছাড়া বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের আমলা ও স্বাধীন দেশের আমলাদের ধরণ, ধারণ ও চরিত্র প্রায় একই। ওরা কখনও ওদের রূপরেখা ও স্বার্থের বাইরে যেতে চায় না। স্বাধীন দেশে যতদিন আমলাতন্ত্র থাকবে ততদিন দেশের জনগণ প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে আখ্যায়িত আমলাদের কাছ থেকে কোনো কিছুর প্রত্যাশা নিস্ফলেরই শামিল।
প্রজাতন্ত্রের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার রাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেবক হিসেবে আইন প্রণয়ন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই অর্গানোগ্রামকে সামনে সম্প্রসারিত ও জবাব দিহীতার বাস্তবায়ন করা। যেখানে রয়েছে স্বাধীনতার সুষ্পষ্ট ও মূল অঙ্গীকার। এছাড়া ৭২ এর সংবিধানেও রয়েছে এর দিকদর্শন। এদেশের জনগণ বৃটিশ ও পাকিস্তানিদের মতো কারও তাবেদার নহে। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। এছাড়া বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে অবিচল আস্থাশীল ও বিশ্বাসী।
পরিশেষে বলব, চাপিয়ে দেয়া আমলাতন্ত্র বিবেকবর্জিত ও পরাধীনতারই নামান্তর। স্বাধীন সার্বভৌম দেশে আমলাতান্ত্রিক বিষফোঁড়া কারও কাম্য হতে পারে না। তেল এবং পানি যেমন একসাথে মিশে না তেমনি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আমলাতন্ত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে একসাথে চলার সুযোগ একেবারেই পরাহত। স্বাধীনতার অর্জনকে ধরে রাখতে হলে আমলাতন্ত্রকে বিদায় জানাতে হবে। তা না হলে গভর্নমেন্ট অব দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার উপাখ্যানটির মর্যাদা ও পুরত্ব নিয়ে আলোচিত ও সমালোচিত হলে দুঃখ, বেদনা পাওয়া ছাড়া তেমন কিছু না পাওয়ারই কথা। সাংবিধানিকভাবে দেশের জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস ও দেশের শাসন, প্রশাসন ও সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের সেবক। ইহাই বাস্তবতা ও স্বাধীনতার মূল মন্ত্র। বৃটিশ ও পাকিস্তানিদের সৃষ্ট আমলাতন্ত্রের ভূত ও দেবতা নির্বাসিত হয়ে স্বাধীন দেশের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জনগণের প্রকৃত বন্ধু, সুহৃদয় ও সেবক হিসেবে যাতে পরিচালিত ও পরিগণিত হয় ইহাই জন প্রত্যাশা।
এদেশের সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এদেশেরই সন্তান। সাত সমুদ্র তের নদী ও পাঞ্জাব, বেলুচ ও কাশ্মীরের কেহ নহে। দেশ, জাতি, জনগণের জন্য তাদের দরদ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও স্বাধীনতার জন্য তাদের ত্যাগ ও অবদান কোনো অংশে কম থাকার কথা নহে। আমলাতন্ত্রের অপবাদ ও নিবন্ধে উল্লেখিত ভূত ও আমলাতন্ত্রের দেবতার সমালোচনা থেকে তাদের দুরে থাকাই শ্রেয় ও পাথেয়।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট