১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬ নং সেক্টরের সম্মূখ যুদ্ধের প্রথম শহীদ লুৎফর রহমানের ৫০ তম শাহাদত বার্ষিকী পালন করা হয়েছে।
ফুলবাড়ী সাহিত্য পরিষদ, ফুলবাড়ী উপজেলা প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ফুলবাড়ী শাখার উদ্যোগে প্রতিবছরের মতো এবারও ২৮ মার্চ এই বীর শহীদের শাহাদত বার্ষিকী পালন করা হয়।
এ উপলক্ষে রোববার সকাল ১১ টায় ফুলবাড়ী উপজেলা শহরের শহীদ লুৎফর রহমান স্মরণী সংলগ্ন স্টুডেন্ট কেয়ার হাইস্কুলের একটি কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় অলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল। এতে সভাপতিত্ব করেন ফুলবাড়ী উপজেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা ইউসুফ আলী সংগ্রামী।
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব কুড়িগ্রাম জেলা শাখার উদ্যেক্তা ও আহ্বায়ক সাংবাদিক ইউনুছ আলী আনন্দের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহেদুল হক, ফুলবাড়ী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম রিজু, মিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারন সম্পাদক মিজানুর রহমান, সাংবাদিক মনিুল ইসলাম প্রমূখ।
এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মহির উদ্দিন, সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ, হাসানুর রহমান, সবুজ মিয়া, হামিদা খাতুন, অরিফা খাতুনসহ আরও অনেকে।
বক্তারা বলেন, শহীদ লুৎফর রহমানসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফুলবাড়ীকে হানাদার মুক্ত রাখার অবদান রেখেছেন। তাদের কারণে আমরা ফুলবাড়ীবাসী অনেকটা হানাদার মুক্ত ছিলাম। সামনের দিনে বড় পরিসরে শহীদ লুৎফর রহমানের শাহাদত বার্ষিকী পালন ও তার পরিবার বর্গকে সম্মাননা দেয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান বক্তারা।
আলোচনা সভা শেষে শহীদ লুৎফর রহমানের রুহের মাগফেরাতে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। দোয়া পরিচালনা করেন বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় প্রতিষ্ঠিত শেখ ফজিলাতুনেছা সরকারি দাখিল মাদ্রাসার সুপার আমিনুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সারা দেশের মতো কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী এলাকার দেশ প্রেমিক বাঙালিরা সোচ্চার হতে থাকে। ১৯৭১ এর ২৮ মার্চ ভূরুঙ্গামারীর জয়মনি থেকে আসা একদল পাক হানাদার ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করলে ফুলবাড়ীর কৃতী সন্তান সাহসী পুরুষ মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক বীর প্রতীক মরহুম বদরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে শহীদ লুৎফর রহমানসহ প্রায় অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধার একটি দল হানাদারদের পরাস্ত্র করার জন্য তাদের পিছু নেয়।
পাক বাহিনীদের লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ারিং পজিশন নিতে গেলে রাস্তায় সাধারণ মানুষের কারণে গুলি করতে পারেনি। পরে ফুলবাড়ী থেকে ধরলা নদীর কুলাঘাট পার হয়ে লালমনিরহাট সদরের নেছারিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় পাক হানাদার দলটি পৌঁছিলে সেখানেই পজিশন অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেন।
এই যুদ্ধটিই ৬ নং সেক্টরের প্রথম যুদ্ধ বলে জানিয়েছিলেন ফুলবাড়ীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও এ সম্মুখ যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বীর প্রতীক মরহুম বদরুজ্জামান মিয়া। এই ৬ নং সেক্টরের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন শহীদ লুৎফর রহমান। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে লুৎফর রহমান ফুলবাড়ীর গংগারহাট ক্যাম্পে ইপিআরের হাবিলদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
৬ নং সেক্টরের প্রথম এই বীর শহীদ লালমনিরহাট নেছারিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে সাথী মুক্তি যোদ্ধাদের কাছ থেকে গুলি চাওয়ার জন্য মাথা উঁচু করলে পাক হানাদারের ছোঁড়া একটি গুলি তার মাথা ভেদ করে। সেখানেই শহীদ হন লুৎফর রহমান। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে লুৎফর রহমান ফুলবাড়ীর গংগারহাট ক্যাম্পে ইপিআরের হাবিলদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের জীবনদানের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে ৬ নং সেক্টরের অধিনস্থ ফুলবাড়ীর মুক্তি যোদ্ধারা দুর্বার হয়ে ওঠেন। ধ্বংস করেন পাক হানাদারের ঘাঁটি। ফুলবাড়ীকে রাখেন শত্রু মুক্ত। শহীদ লুৎফর রহমানের নামে ফুলবাড়ী সদর থেকে ফুলসাগর পর্যন্ত একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে শহীদ লুৎফর রহমান স্মরণি।
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই শহীদ বীর মুক্তি যোদ্ধাকে উপজেরা প্রশাসনসহ ফুলবাড়ীবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তার কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পন ও কবর জিয়ারত করে আসছে। ফুলবাড়ী উপজেলাবাসী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত করার দাবি করে আসছেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লুৎফর রহমানের পারিবারিক ঠিকানা ও তার পরিবার বর্গের খোঁজ পাওয়ার জন্য সাংবাদিক ইউনুছ আলী আনন্দ প্রেরিত দাবি সংবিলত একটি স্মারকলিপি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালায়সহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এর সদর দপ্তর ঢাকার পিলখানা থেকে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের পারিবারিক ঠিকানা ও পরিবার বর্গের খোঁজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
পিলখানা থেকে পাওয়া তথ্য ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহীদ লুৎফর রহমানের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনইমুড়ি উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বজরা গ্রামে। এখানে শহীদ লুৎফর রহমানের স্ত্রী আমেনা বেওয়া (৭৭), তার একমাত্র ছেলে সৌদি প্রবাসী মতিউর রহমান, নাতী মিতুল ও সিতুল, বিবাহিত নাতনী মোহিনী ও মিতিলাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা বসবাস করছেন।