প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের রেকর্ড। মারা যাচ্ছেন প্রতিদিন অর্ধ শতাধিক মানুষ। কিন্তু তারপরেও সচেতন হচ্ছেন না বাংলাদেশের মানুষ। তারা পথে-ঘাটে, বাজারে-শপিং মলে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ইচ্ছে মতো ঘুরাফেরা করছেন। যদিও সরকার ঘোষিত লকডাউন চলছে। পরিস্থিতির বেগতিক দেখে করোনা নিয়ন্ত্রণ জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি দেশে ২ সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন দেবার পরামর্শ দিলেও আগামী ১৪ই এপ্রিল থেকে সপ্তাহব্যাপী কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। বন্ধ থাকবে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস, চলবে না কোনো গণপরিবহন। সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কিভাবে চলবে? গত বছর লকডাউনের সময় সরকারসহ দেশের সামর্থবানেরা খাদ্য সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু এবার তেমনটা চোখে পড়ছে না। দু-চারজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে সহায়তা দিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে, তবে তা নিত্যান্তই অপ্রতুল। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা পয়সায় মাস্ক বিতরণ করলেও স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে খুব একটা কঠোরতা দেখাতে পারেনি। যদিও কিছু ক্ষেত্রে কিছু জরিমানা আদায় করা হয়েছে।কাজেই লকডাউনের উদ্দেশ্য ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বাড়ছে আক্রান্ত, মরছে মানুষ।
১৪ই এপ্রিল থেকে মুসলমানদের রহমত বরকত মাগফিরাতে পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখও সেদিন। কিন্তু সারাদেশে করোনার কারণে পহেলা বৈশাখে সব আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে। রমনার বটমূলে নতুন বছরের সূর্যকে বরণ করতে বাজবে না কোনো সুর। জাতীয় ভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও খুব সীমিত পরিসরে সাম্প্রতিকতার বিরুদ্ধে করা হবে। ঘরে ঘরে পান্তা ইলিশ নিয়েও নেই তেমন তোড়জোড়। তবে শপিং মল ও বাজার খুলে দেয়ায় ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে আশঙ্কাজনক ভাবে। বাজার ও কমিটির কর্তাব্যক্তিরা বলেছিলেন, সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা কেনা বেচা করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো- ক্রেতা কিংবা বিক্রেতা কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। তারা বৈশাখ ও ঈদের বাজার করা নিয়ে ব্যস্ত। অন্যদিকে বাজারে নিত্য পণ্যের দাম হঠাৎ করেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পরিবহন সমস্যার কথা বলে। চালসহ তরি-তরকারির দাম বেড়ে গেছে। একে তো লকডাউন তার ওপর মুক্ত পণ্যের উর্ধগতি মড়ার ওপর খারার ঘা হয়ে উঠেছে। অবশ্য বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালাচ্ছেন নিয়মিত। কিন্তু অভিজান শেষে যা ছিল আবার তাই। অতিরিক্ত টাকা জনগণের পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করোনার কারণে বন্ধ থাকলেও মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ভর্তি আর বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রে যে দৃশ্য দেখা গেছে তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষনই দেখা যায় না।
অনেকেই পবিত্র রমজান ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ভিন্ন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পহেলা বৈশাখের শাড়ি- পাঞ্জাবি সকালে না পরে সন্ধ্যায় ইফতারির সময় পরে ইফতার করবেন। পান্তা ইলিশের পরিবর্তে রকমারি ইফতারি খাবেন। করোনা মৌসুমে পান্তা পরিহার করাই উত্তম। এদিকে এবারে রমজানে মসজিদে মসজিদে সেহেরি ও ইফতারি করা যাবে না। হোটেল থেকে সেহেরি ইফতারি কেনা যাবে কিন্তু হোটেলে বসে খাওয়া যাবে না। বাসায় বসে সেহেরি ইফতারি করতে হবে। নামাজের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ আদায় করতে হবে। মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না। বাসা থেকে জায়নামাজ নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রনালয় সৌদি আরবের আদলে এ নির্দেশনা জারি করেছে। গত ৮ এপ্রিল থেকে সারা দেশে ২য় ডোজ করোনা টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। তবে লক্ষনীয় ব্যাপার বিভিন্ন হাস্পাতালে টিকা নেয়ার জন্য যারা যাচ্ছেন তারাও ঠিক ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। টিকা নেয়ার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন একজন আরেকজনের গা ঘেঁষে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছেন না। টিকা নেয়ার পরও কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপচে পড়া ভীড়। আইসিইউর অপ্রতুলতাও চোখে পড়ার মত। যদিও গত বছর করোনা সংক্রমণের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন, সব জেলায় আইসিইউর সুযোগ বাড়ানো হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত সে ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। কবে হবে তাও কেউ বলতে পারে না। অথচ করোনা রোগীর জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা অপরিহার্য।
এদিকে করোনার কারণে দেশের রাজনীতি পুরোপুরি স্থগিত হলেও অনলাইনে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি বচসা চলছে। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানকে সরকার দলীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে। সব দলকে নিয়ে সার্বজনীন অনুষ্ঠান করতে না পারায় সরকারের হীনমন্যতা প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। অন্যদিকে এই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিতর্কিত করেছে সরকার। এজন্য হেফাজতে ইসলামি সারাদেশে যে তান্ডব চালিয়ে তা সত্যি দুঃখজনক। চট্টগ্রামের হাটহাজারী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তান্ডব কেড়ে নিয়েছে দেড় ডজন তাজা প্রাণ। সরকার এখন লকডাউনের মধ্যে এসব ঘটনার মামলা ও আসামি গ্রেফতার নিয়ে ব্যস্ত। সব রাজনীতি এখম নীরব। বিষয় এখন হেফাজতে ইসলাম। ধর্মীয় লেবাস পড়ে রাজনীতির মাঠে তারা কি ফায়দা লুটতা চায় তা অজানা। দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামে কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও ধর্মীয় রাজনীতি তারা এখনো অব্যাহত রেখেছে।
রমজানের প্রথম সপ্তাহে লকডাউনে যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আসে তবে সন্দেহ নেই লকডাউনের সময়সীমা আরও বাড়বে। ঘরবন্দী মানুষ কিভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করবে এ পবিত্র মাসে তা সত্যিই চিন্তার বিষয়।