পরিবার ও সমাজে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে নারীর অবমাননা বা নির্যাতন। যৌতুকের জন্য, ফতোয়ার শিকার হয়ে, স্বামীর পরকীয়ার কারণে, ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের শিকার হয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবর-ননদের অত্যাচার-নির্যাতনে এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এ দেশের অনেক অসহায় নারীর প্রাণ চলে গেছে, এখনো যাচ্ছে। নারী নির্যাতন রোধে নারী সংগঠন, নারীবাদীরা এমনকি সরকারও সোচ্চার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু করোনাকালেও নারীর অবমাননা বা নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। পরপর দুটো ঘটনা আমাদের হতবাক করে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় এক নারীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ও পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত ৯ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শনিবার দুপুরে পটুয়াখালী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পুলিশ সুপার। নির্যাতনের শিকার আকলিমা আক্তার বর্তমানে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ছাড়াও বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় চারজন মিলে এক তরুণী গৃহকর্মীকে (২৫) ধর্ষণ করেছেন। বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার একটি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই তরুণীর করা মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে মানিকগঞ্জ, সাভার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও বরিশালে চলন্তবাসে এবং সিএনজিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বেশ কয়েকটি। গত বছরের প্রথম ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৪৬ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছেন ৫৩ জনকে। আর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪১ জন নারী। এসব ঘটনা ঘটছে প্রতিকারহীনভাবে- যা অত্যন্ত উদ্বেগের। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্র আপসহীন না হলে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ না করলে সমাজের ভেতরে এই অবক্ষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে না। মনে রাখতে হবে, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেবলই ভোগবাদী। তারা নারীকে সব সময় ভোগের বস্তু হিসেবেই গণ্য করে থাকে। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েই পরিবার ও সমাজের জন্য অনিবার্য। নারীর সবচেয়ে গস্নানিময় অপমানসূচক অধ্যায় হচ্ছে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া। এ দেশের নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার নানাভাবে হতে পারে। তবে এর দুটো দিক রয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে যৌন নির্যাতন। কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তি মানে ও বোঝে। মানুষের দুঃখ শোকে কাতর হন যিনি, সহমর্মিতা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নারী অবমাননাকারী নির্যাতক বা হত্যাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিকতা সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নির্যাতন হত্যা কেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। তবে তার আগে প্রয়োজন দেশব্যাপী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, দারিদ্র্য বিমোচনে ও বেকারত্ব দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করলে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের নারীদের আরও দীর্ঘ পিচ্ছিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে।