সেই আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে শুভ্র তার প্রিয় তমশীর জন্যে, হাতে একগুচ্ছ কদম, একটি নীল রংয়ের শাড়ি, আর ছোট্ট কানের দুল নিয়ে। কদমের দিন এলেই শুভ্রর একগুচ্ছ করে কদম লাগে প্রতি সপ্তাহে। কারণ, শুভ্রর পাগলীটা যে কদম ফুল অনেক বেশি ভালোবাসে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে গেলো শুভ্রর। মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই। কীভাবে থাকবে বিরক্তির ছাপ? শুভ্র তার প্রিয় তমশীকে এতোই ভালোবাসে যে মরার আগ পর্যন্ত এই ভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারবে তার প্রিয় মানুষটার জন্য। শুভ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তমশীর সাথে প্রথম যে দিন দেখা হয়েছিলো সে দিনের কথা ভাবছে। শুভ্রর এখনো সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে।
সে দিন ছিলো বৃহস্পতিবার। তমশী তার ছোট বোন তমার সাথে আর্ট একাডেমিতে এসেছিলো। তমা আর্ট শিখে যে একাডেমিতে সেই একাডেমির হেড এবং আর্ট টিচার হচ্ছে শুভ্র। তমশী যখন একাডেমির গেট দিয়ে প্রবেশ করে তখনই শুভ্রর চোখ আঁটকে যায় তমশীর উপর। এক দৃষ্টিতে সে দেখতে থাকে তমশীকে। তমশী ব্যাপারটা খেয়াল করেও এড়িয়ে চলে যায় তমার সাথে। শুভ্র তমাকে দেখে ডাক দিলো। তমা সাথে সাথে শুভ্রর সামনে গিয়ে বলল, আস্সালামু আলাইকুম ভাইয়া।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম।
- ভাইয়া কিছু কি হয়েছে?
- না তো, কেনো?
- হঠাৎ ডাক দিলেন যে!
- ও আচ্ছা! এমনেই ডাক দিলাম।
- ও আচ্ছা।
- আমি তাহলে যাই?
- হুম, যাও।
শুভ্র যতক্ষণ তমার সাথে কথা বলছিলো ততক্ষণ শুভ্রর পুরো খেয়াল তমশীর উপর ছিলো। তমা আর তমশী চলে যেতে নিলে শুভ্র আবার তমাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তমা তোমার সাথে ও কে?
- ভাইয়া ও আমার বড় বোন তমশী।
- বাহ নামটা তো খুব মিষ্টি। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমন নামটাও মিষ্টি।
কথাটা বলেই শুভ্র তমশীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তমশী চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। তমা তমশীর চোখ গরম দেখে শুভ্রর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া আপনে ওকে চিনেন না। ও যেই মেয়ে! আমি নিজেই ওর থেকে সাবধানে থাকি। ওর থেকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল।
শুভ্র কথাগুলো শুনে শুধু হেসেছিলো। তমশী তমার হাত ধরে চলে গেলো সেই জায়গা থেকে। আর শুরু হলো শুভ্রর নতুন একটি কাজ। প্রতিদিনের কাজের মধ্যে নতুন যে কাজটি যুক্ত হলো, তা হলো তমশীকে দেখা। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন আধ ঘন্টা করে শুভ্র তমশীকে দেখে। তমশী প্রতি দিন বিকেল বেলা ছাদে এক কোণে বসে গান শোনে। সেই সুযোগে শুভ্র তমশীকে দেখে। তমশীকে দেখার জন্য শুভ্র তমশীদের পাশের বিল্ডিংয়ে ভাড়া নিয়েছে। শুধু বিকেলে আসে তমশীকে দেখার জন্য। বাসাটা খালিই থাকে। বাসাটা ভাড়া নেওয়ার একটাই কারণÑ তমশী। মাঝে বাড়িওয়ালার লাভ। প্রথমে এসব কর্মকা-ে তমশী প্রচুর পরিমাণে বিরক্ত হলেও এখন আর বিরক্ত হয় না। উল্টো কখন শুভ্রকে দেখতে পারবে এখন সে সেই আশাতেই থাকে।
ধীরে ধীরে শুরু হলো চোখে চোখে কথা বলা। ৬ মাস হয়ে গেছে কিন্তু এখনো কেউ কাউকে ভালোবাসি কথাটা বলেনি। অথচ দু’জনই জানে দু’জন দু’জনকে কত ভালোবাসে। কিন্তু শুভ্র প্রতিনিয়ত তমশী যা পছন্দ করে তা করে যাচ্ছে। আবার শুভ্র যা পছন্দ করে তমশী তা করে যাচ্ছে। শুভ্র যে দিন থেকে জেনে সে তমশীর কদম ফুল অনেক পছন্দের সে দিন থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার তমশীদের ছাদে কদম ফুল রেখে দেয়। তমশী যখন ছাদে এসে কদম ফুলগুলো হাতে নিয়ে এক চিলতে হাসি দেয় তখন শুভ্রর থেকে বেশি সুখী আর এই দুনিয়াতে কেউ হয় না।
শুভ্র আর তমশীর তেমন ফোন কথা হতো না। কিন্তু সারাক্ষণ মেসেজ দিতো একজন আরেক জনকে। শুভ্র আর থাকতে না পেরে একদিন ঠিক করলো তমশীকে তার মনের কথা বলে দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ। শুভ্র তমশীকে মেসেজ দিলোÑ আজকে বিকেল চারটায় প্রথম যে দিন যে খানে দেখা হয়েছিলো, সেখানে অপেক্ষা করবো তোমার জন্যে।
মেসেজটা দেখে তমশী অনেক বেশি খুশি হয়েছিলো। এই দিনটার জন্যই যে কতই না স্বপ্ন বুনেছিলো তার কোনো হিসাব নেই তমশীর কাছে। ঠিক তিনটায় রেডি হয়ে নিলো তমশী। ঠিক যেমনটা শুভ্র পছন্দ করে। নীল রংয়ের শাড়ি, কানে ছোট্ট দুল, কপালে একদম ছোট একটা কালো টিপ, চোখে হালকা করে কাজল আর খোলা চুল এইতো শুভ্রর পছন্দ। তমশী রেডি হয়ে বসে আছে কখন চারটা বাজবে। সময় যে বড়ই অদ্ভুত! যখন ধীরে যাওয়ার দরকার তখন তাড়াতাড়ি যায়, আর যখন তাড়াতাড়ি যাওয়ার দরকার তখন মনে হয় এক সেকেন্ড হাজার সেকেন্ডের সমান। তমশী আর অপেক্ষা করতে না পেরে বের হয়ে গেলো।
এদিকে সেই এক ঘন্টা থেকে অপেক্ষা করছে শুভ্র কিন্তু তমশীর কোনো খবরই নেই। শুভ্রর প্রচুর পরিমাণে ভয় হচ্ছে। কিছু একটা হারনোর ভয়। শুভ্র মনে মনে ভাবছেÑ মেয়েটা কি তাহলে অন্য কাউকেৃ.! তাহলে এত দিন কী ছিলো!
প্রায় দুই ঘন্টার মতো অপেক্ষা করলো শুভ্র। কিন্তু এই দুই ঘন্টায়ও তমশীর কোনো খবর নেই। শুভ্র আর থাকতে না পেরে ফোন দিলো তমাকে। অনেকবার ফোন দিয়ে যখন তমাকে পেলো না তখন শুভ্রর ভয় আরও বেড়ে গেলো। শেষমেশ আর থাকতে না পেরে পা বাড়ালো তমশীর বাসার দিকে।
তমশীর বাসার সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াতেই থমকে গেলো শুভ্র। তমশীর বাসার সামনে একটি লাশবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটির আশপাশে তমশীর বাবা, মা আর তমা দাঁড়িয়ে আছে। তমা তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তমশীর মাও কাঁদছে। বুকের মধ্যে কেমন জানি অজানা ভয় এবং ব্যথা শুরু হয়ে গেলো শুভ্রর। শুভ্র এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়েই আছে। সামনে পা বাড়াতে একদমই পারছে না। তার মনে হচ্ছে সে বরফ হয়ে গেছে। তমা যখন শুভ্রকে দেখলো তখন দৌড়ে সামনে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে একটা কথাই বলেছিলো, ভাইয়া আপপপপপু!
বলেই আবার কাঁদতে লাগলো তমস। শুভ্র চেয়েও তমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারেনি। শুভ্র এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে জমে গেছে। রীতিমতো তার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে সে তমাকে সরিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। গাড়ির সামনে যেতেই তমশীর বাবা শুভ্রকে দেখে কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। শুভ্র রীতিমতো অবাক হলো। অবাক হওয়ারই কথা। শুভ্র জানতো না যে তাদের কথা তমশীর বাসার সবাই জানতো। শুভ্র তমশীর বাবাকে সামলে নিলো। অনেক কষ্টে সে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করলো তমশীর বাবাকে, আঙ্কেল কীভাবে কী হয়েছে?
তমশীর বাবা কান্না করতে করতে উত্তরে বলেছিল, বাবা তমশী বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নেয় তোমার একাডেমির জন্য। অর্ধেক রাস্তায় যেতেই পিছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা দেয়। আর তারপর আশেপাশের মানুষ তমশীকে হসপিটালে নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে তমশীৃ বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তমশীর বাবা। শুভ্র এতক্ষণ নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলেও এখন আর সামলাতে পারলো না। শুভ্র তমশীর বাবাকে একটু ঠান্ডা করে এগিয়ে গেলো গাড়ির ভিতর থেকে তমশীর মৃতদেহ নামাতে। শুভ্র এবং আশেপাশের কয়েকজন মিলে তমশীকে নামালো। তমশীকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তমশী শুয়ে আছে হসপিটালের চার পা-ওয়ালা খাটে। শুভ্র তমশীর মাথার কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তমশীর মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরালো। কাপড় টা সরাতেই থমকে গেলো শুভ্র। ঠিক শুভ্র যেমন পছন্দ করে সেই ভাবে সেজেছে তমশী। তমশীর শরীর থেকে এখনো কিছু খোলা হয় নি। হসপিটালের নার্সরা খুলতে চাইলেও তমশীর বাবা খুলতে দেয়নি। শুধুমাত্র শুভ্রর জন্য তমশীর বাবা এই কাজটা করে। শুভ্র যেনো শেষবারের মতো তার প্রিয় তমশীকে দেখতে পারে তার মনের মতো করে। শুভ্র একদৃষ্টিতে দেখছে। সে চুপ করে আছে। চোখে এক ফোঁটাও পানি নেই। তার চোখে পানি না থাকলেও মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যেই ঝড় কেউ না দেখলেও ক্ষতি কম হচ্ছে না। শুভ্র নিজ হাতে তমশীর কানের কানের দুলটা খুলে নিজ পকেটে রেখে দিলো। তারপর নিজের হাত দিয়ে তমশীর পুরো মুখ ছুঁয়ে দিলো। এটাই প্রথম এবং শেষ স্পর্শ। শুভ্র তমশীর দুই গালে হাত রেখে প্রায় অনেকক্ষণ লাগিয়ে তমশীর কপালে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করলো। এটাই শুভ্রর জন্য প্রথম এবং শেষ চুমু তমশীর কপালে।
তমশীর সবকিছু খুলে ফেলার পর যখন শাড়িটা ফেলে দিতে নিয়েছিলো তখন শুভ্র তমশীর মার থেকে শাড়িটা চেয়েছিলো। তমশীর মাও মানা না করে শাড়িটা শুভ্রকে দিয়ে দিয়েছিলো।
চার বছর হয়ে গেছে তমশী মারা গেছে। এখনো শুভ্র প্রতি সপ্তাহে তমশীর কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহে এক দিন তমশীর জন্য বরাদ্দ। আর কদমের দিন এলে একগুচ্ছ কদম নিয়ে আসে সে তমশীর জন্য। এটাও বরাদ্দ করা।
শুভ্র এখনো দাঁড়িয়ে আছে তমশীর কবরের সামনে। প্রতি সপ্তাহে এসে এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে পুরোনো স্মৃতি তাজা করে সে। শুভ্রর সাথে থাকে তমশীর শেষ পরা শাড়িটা আর কানের দুলটা। এই দু’টো বলতে গেলে শুভ্রর সবসময়ের সঙ্গী। তমশী যাওয়ার পর থেকে শাড়িটা একটা দিনের জন্য নিজের থেকে আলাদা করেনি শুভ্র। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর সময় সে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে শাড়িটা। শুভ্র মনে করে শাড়িটার মধ্যে লেগে আছে তমশীর গায়ের ঘ্রাণ আর শেষ স্পর্শ।
সব সময়ের মতো এবারও হাতে থাকা একগুচ্ছ কদম তমশীর কবরের উপর রেখে আস্তে করে কবরে একটা চুমু খেয়ে শুধু একটা কথাই বলল শুভ্র, ভালোবাসি প্রিয় তমশী!