বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে কেবল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে আমজনতা। তাদের রুটি-রুজী-জীবন-জীবীকা প্রতিটি সরকারের সময়েই হুমকির মুখে পড়েছে। এই সুযোগে গড়ে তুলেছে ছাত্র-যুব-শ্রমিক আর মূল দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক ফায়দা। সেই সুযোগে প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও গড়েছে টাকার পাহাড়-বাড়ি-গাড়ি আর দুর্নীতির রাজত্ব। মধ্যিখানে নিরন্নদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত। বিশ^ব্যাপী যখন নির্মম মহামারি চলছে, তখনো নীতি বিবর্জিত অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি করেই যাচ্ছে ক্ষমতাসীন-সাবেক ক্ষমতাসীনরা। রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক কালো পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দোসররা।
নিরন্ন মানুষের রুটি-রুজী-জীবন-জীবীকা নিয়ে না ভাবলেও লকডাউনের মত অবিরত অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত জনগনের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে বারবার। অন্যদিকে ‘করোনার সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যর্মীদের সম্মানী (দুই মাসের অতিরিক্ত বেতন) ভাতাসহ তিনটি কর্মসূচি চালু থাকছে আগামী অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে। বাকি দুটি হচ্ছে-সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে সরকারি চাকরিজীবীদের মৃত্যুজনিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং কোভিড-১৯ প্রভাবে কর্মহীনদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঋণ দেয়া। এসব কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসাবে থাকবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ খুব শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে।’ বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবারের মত এবারও বাজেট বিষয়ক আশ^াস দেয়া হচ্ছে। যদি দেশকে ভালোবেসে সত্যিকার্থে তিনটি কর্মসূচি আগামী বাজেটে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তা তাহলে খুবই ভালো। কারণ করোনার প্রভাবে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর বিপরীতে কর্মসৃজন কর্মসূচি চালু রাখার উদ্যোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স কাজ করছেন তাদের সম্মানী ভাতা দিতে হবে। এতে তারা আরও বেশি উৎসাহ নিয়ে কাজ করবেন। তারা মানবিক হিসাবেও কাজ করছেন। উচিত হবে এ কর্মসূচি চালু রাখা। এ মুহূর্তে অর্থনীতি ঠিক রাখতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দিকে আরও জোর দিতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ এসব কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে পড়বে। পাশাপাশি করোনার প্রভাবে কোটি কোটি কর্মহীন মানুষের কথা ভেবে দুর্নীতিমুক্তভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন অর্থাৎ এখনও কাজে ফিরতে পারেননি।
গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি যে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নাধীন আছে। এরমধ্যে ৫৭০ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। বাকি ৯৩০ কোটি টাকা নতুন বাজেটে বরাদ্দ থাকছে। এর মধ্যে এসএমই খাত সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য আগামী বাজেটে এসএমই ফাউন্ডেশনকে ২শ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে (বিসিক) ৮০ কোটি টাকা, জয়িতা ফাউন্ডেশনকে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এনজিও ফাউন্ডেশন ৪০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ২শ কোটি টাকা, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনকে ১৫০ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে ৭০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডকে ১৫০ কোটি টাকা দেয়া হবে।’ এখন কথা হলো লোভ মোহহীনভাবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে যদি দুর্নীতিমুক্তভাবে এসব প্রতিষ্ঠান বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে স্বল্প সুদে ঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় এবং বিশেষ করে গ্রামীণ কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দেয়ার মধ্য দিয়ে এমন বড় বাজেটের অর্থ ব্যবহার করা হয়, তাহলে অন্তত স্বাধীনতার ৫০ বছরের ব্যর্থতা কিছুটা হলেও ঘুচবে বলে বিশ^াস করি।
করোনা পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন চিকিৎসাকর্মীরা। এ জন্য চিকিৎসা সেবায় জড়িত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এককালীন সম্মানী ভাতা (দুই মাসের অতিরিক্ত বেতন) দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় ১৫০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ হাজার ৯৪০ ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে ২ মাসের বেতন সমতুল্য সম্মানী ভাতা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডাক্তার আছেন ২ হাজার ৭৮৩ জন। এছাড়া ১ হাজার ১৫২ জন নার্স ও দুই হাজার ৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এক্ষেত্রে ব্যয় হয় ৩১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মানবিক দিক থেকে সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। ফলে তাদের যে সম্মানী দেয়া হচ্ছে এ করোনাকালীন, তা আগামী অর্থবছর বাজেটেও চালু রাখার সিদ্ধান্ত যেন ঘূণপোকা খেয়ে না ফেলে এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কৃষি-শিক্ষা-খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান নিয়েও চাই বাজেটের একটি বড় অংশ। সেই অংশে যেন নীতিবানদের আন্তরিকতা থাকে। কালো মানুষরা গত বাজেটে যেভাবে বঞ্চিত করেছে ভাসমান মানুষদেরকে, কৃষকদেরকে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে-নারী ও শিশুদেরকে সেভাবে বাজেট যেন এবার আর অন্ধকারের দিকে ধাবিত না হয়; একথা ভেবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে হবে বিন¤্র ভালোবাসা-শ্রদ্ধা।
করোনার মধ্যে মাঠপর্যায়ে ত্রাণ বিতরণসহ সরকারের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে জড়িত আছে সরকারি চাকরিজীবীরা। আর এ কাজটি করতে অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান চালু করা হয় চলতি অর্থবছরের বাজেটে। বিশেষ করে বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রথম থেকে ষষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তা পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে ৫০ লাখ টাকা দেয়ার বিধান চালু করা হয়। পাশাপাশি মৃত্যু কর্মকর্তার বেতন গ্রেড ১০ থেকে ১৪ পর্যন্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবেন সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। আর গ্রেড ১৫ থেকে ২০-এর মধ্যে দেয়া হলে ২৫ লাখ টাকা। এ জন্য চলতি বাজেটে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত চাকরিজীবীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ নীতিমালার আওতায় ১শ জনের উপরে মৃত চাকরিজীবীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে অনেক পরিবার। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে গেছে। সহসা এটি শেষ হচ্ছে না। ফলে বিদ্যমান এ আর্থিক ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি আগামী অর্থবছরেও চালু রাখার চিন্তাকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি সরকারি আর ১ টি টাকাও যদি দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয় তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাবো প্রতিবাদের জন্য।
এখানে এসে সরকারের রাজনৈতিক কর্ম নিয়ে আমজনতাকে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। গত ২ বছরে রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন ঘোষণা দিলেও চলতি বছর এপ্রিলে এসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষিদ্ধকৃত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নতুন করে পূর্ণজীবিতর পর থেকে ক্রমশ সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন চলমান সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তারা বলছেন, নিরন্নদের পাশে থাকার জন্য লকডাউনে অসহায় কর্মহীন মানুষের আর্থিক সুরক্ষায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নিম্ন আয়ের প্রায় ৩৫ লাখ পরিবার এবং অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় এক লাখ কৃষকসহ ৩৬ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করবেন। তিনি নিম্ন আয়ের মানুষের পরিবারপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবার প্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করবেন। এ বাবদ সরকারের ৯৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।’ বলা হচ্ছে-এটা করা হবে, ওটা করা হবে; কিন্তু এই হবে কেবল কাগজপত্রেই থেকে যাচ্ছে বারবার। যে কারণে নিরন্নদের সংখ্যা কখনো কমছেই না। বরং বেড়ে চলছে অন্ধকারের চর্চা, দুর্নীতির রামরাজত্ব বানানোর চেষ্টা।
অন্ধকারের রাজনীতি থেকে উত্তরণের জন্য নিবেদিত প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। নিরন্তর সেই চেষ্টার হাত ধরে রাজপথে থাকার কারণে যখনই অন্যায় দেখেছি-প্রতিবাদ করেছি। গতবারের বাজেট গণবিরোধী হওয়ায় আমজনতার পক্ষ থেকে লালকার্ড দেখিয়েছি, প্রয়োজনে আবার লালকার্ড দেখাবে বাংলাদেশের মানুষ। যদি দেশকে ভালোবেসে সত্যিকারের গণবান্ধব বাজেট অর্থমন্ত্রী না নিয়ে আসতে পারে, যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর সদিচ্ছার সবটুকু দিয়ে আমজনতার নিরন্নতা কাটানোর চেষ্টা না করেন, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা রাজপথে থাকবে অধিকারের জন্য নিরন্তর...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি