ঘরের দোতলার দক্ষিণ দিকের রুম। দু’টি জানালা, দু’টি দরজা। দু’টি দরজার একটি দিয়ে প্রবেশ করে অপরটি খুললেই দক্ষিণের বেলকনি। ছাঁদ দেবার সময় সামনে বেলকনি থাকতেও পেছন দিকে এই বেলকনি দেবার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। কিন্তু যখন শুনলাম এই রুমটা সহ পাশের রুমটাও আমার জন্যই তৈরী করা হচ্ছে তখন চোখটাকে সবুজের স্বর্গে কিছুক্ষণের জন্য নিক্ষেপ করে অতঃপর আব্বাকে বললাম, আব্বা! দক্ষিণের রুমটার পিছন দিকে ছোট্ট একটা বেলকনি রাইখেন।
আব্বা শুধু ক্ষীণস্বরে একটু শব্দ করলেন, বড় অদ্ভুত তুই...
ঈদে বাড়ী যাওয়াটা আমার জন্য একটা নেশাগত অভ্যাস। হোক না যতই ঝড়-বৃষ্টি কিংবা তুফান। আমাকে যেতেই হবে। ঢাকা ছাড়ার আগে আম্মাকে শুধু বলেছিলাম, আমি গিয়ে দক্ষিণের রুমটায় ঘুমোবো মা। বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দক্ষিণের রুমটায় ঢুকেই দেখি শীতল পাটির উপরে নকশী কাঁথার আস্তরণ দিয়ে তারও উপর বিছানা পেতে রেখেছেন তিনি। সেই সাথে অবশ্যই একটির উপর আরেকটি মিলিয়ে দু’টো বালিশ (তিনি জানেন যে দু’টো বালিশ ছাড়া আমি ঘুমোতে পারি না; আমার ঘাড় প্রচন্ড ব্যথার সাথে অস্বস্তি লাগে)।
আজ সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ সাথে ঝিরিঝিরি বর্ষণ। রাতে অবশ্য প্রচন্ড বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া রাস্তাঘাট সহ কিছু গাছপালা এলোমেলো করে দিয়ে খানিকটা মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আর যাই হোক, প্রকৃতির মায়াজালের একটা তরতাজা সবুজের প্রাণ চোখের সামনে থেকে চিরকালের জন্য সরে যাবে সেটা আমার সহ্য হয় না। আমার জন্যই কিনা দাদীসহ বাকি দুই চাচা এমনিকি পুরো বংশের কেউই শতবর্ষী রেইনট্রি তো বটেই কোনো গাছের গায়েই কুড়ালের ঘা বসাতে পারে না। যা হয় চুপিসারে, অজ্ঞাতে, অজান্তে!
সকাল ৬ টা ৩৭ মিনিট! ঘুম ভাঙ্গার পর টের পেলাম বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ। চলে এলাম দোতলায়। দক্ষিনের রুমটায় এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম দু’পাশে, খুলে দিলাম দক্ষিণের দরজা। শো শো শব্দের ঝাপটা এসে মায়াজালে আচ্ছন্ন করে ফেলছে আমাকে। আমি তখন পায়ের উপর পা তুলে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছি জানালার দিকে। দৃশ্যটা কী অমূল্য! কী দুষ্প্রাপ্য! বাতাসের সাথে সাথে দুলছে আকাশছোঁয়া সুপারী গাছের এলোকেশী রমনীর দীঘল কালো ভেজা চুলের ন্যায় নুইয়ে পড়া পাতা। বাতাসের শব্দ বাড়ছে, বাড়ছে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর বাড়ছে কেবল মোহমুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতার মায়া আরেকটু বাড়িয়ে দিতে কিনা চলে এলো প্লেলিস্টের ‘একটা ছিলো সোনার কইন্যা, মেঘবরণ কেশৃ..’
হঠাৎ আমার ভ্রম ভাঙ্গে! ঠিক কার ডাক কিসের জন্য সেটা বুঝে উঠতেও আমার একটু সময় লাগে। আম্মা ডাকছে খাওয়ার জন্য। উঠবো উঠবো করে গিয়ে দাঁড়ালাম বেলকনিতে। চোখ গেলো গাবগাছটার দিকে। হালকা লাল খয়েরী ফলে ছেঁয়ে যাওয়া গাছটার শরীর বেয়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে জল। আমি খেয়াল করি খুব সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে! চোখের ঝরে পড়া জল আর এই ঝরে পড়া জলে কি আদৌ কোনো পার্থক্য আছে? থাকার কথা? উত্তর খুঁজতে যাওয়ার প্রাক্কালেই চোখ গেলো সিড়িতে। আব্বা উঠে আসছেন! কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। এসেই হয়তো আবার বলবেন, বড় অদ্ভুত তুই...