কোরবান আলীর নিরন্তর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমিরন অবশেষে গলায় দড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কি হবে আর বেঁচে থেকে? পুরুষ মানুষকে সেআর বিশ্বাস করে না। পর পর দুইজন খসম ছেড়ে যাওয়ায় কোরবান আলীকে নিকা করে সুখের সংসার বাঁধতে চেয়েছিল আমিরন। কি পেলো সে কোরবান আলীর কাছ থেকে ? দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের বিনিময়ে অসহায় নিরাশ্রয় আমিরনের উপর এই বিরতিহীন উপদ্রব আমিরনের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে।
জীবনের খুঁটিনাটি হিসাব মেলাতে গিয়ে আমিরনের প্রথম স্বামী শমসেরের কথা মনে পড়ে। লাল মুলার মতন দেখতে ছিল সে। গ্রামের সবাই বলতো, শমসের আস্তা একটা সাহেবের ব্যাটা। শমসেরের বাবা খুব হত দরিদ্র ছিল। অনেক ছেলে মেয়ে থাকায় শমসেরের বাবা অল্প বয়সে শমসের কে বছর চুক্তি কাজে লাগায় আমিরনদের বাড়ি। আমিরন তখন ষোড়শী। শমসেরকে তার ভালোলাগতে শুরু করে। মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে শমসেরের সাথে কথা বলতো আমিরন। শমসের ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকত। আমিরনের বাবা দবির শেখকে শমসের জমের মতো ভয় পেত। একদিন রাতে মেটে জোসনায় পুকুরঘাটেএকান্তে কথা বলার সময় আমিরনের বাবা দেখে ফেলে। রাগে টগবগ করতে থাকে। চেলা কাঠ দিয়ে বেদম পিটুনি দেয় আর গালাগাল দিতে থাকেশমসেরকে :
-হারামজাদা, দুই টেহার কামলা অইয়া আসমান ছুঁইবার চাস্; নিমকহারাম মারানির পুত কোনহানকার !
হাতে পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলেও আমিরনের বাবা দবির শেখ ক্ষমা করেনি শমসেরকে। মারতে মারতে খালপাড় পর্যন্ত রেখে আসে। আমিরন তার বাবার আচরণে খুব কষ্ট পায়।
একদিন রাতের অন্ধকারে শমসেরের হাত ধরে আমিরন নিরুদ্দেশ হয়। শমসেরকে নিয়ে চলে আসে অনেক দূরে; কদমতলা গ্রাম ছেড়ে সোজা মঙ্গলা বন্দরে। দূরসম্পর্কের এক মামাকে ধরে শমসের জাহাজের খালাসির কাজ নেয়। আমিরন আর শমসের ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সুখেরনীড় রচনা করে। সারাদিন শমসের হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতো। ফিরেই আমিরনকে না দেখতে পেয়ে ডাকাডাকি জোরে দিত :
-আমিরন, অ আমিরন, কই গেলি বউ ?
-সারাডা দিন তরে দেহিনা। পরাণডা কান্দে।
-অ আমিরন, অ আমার সোনার ময়না পঙ্খি, তাড়াতাড়ি আহ দেহি।
পাশের ঘরের ঘাট শ্রমিক আক্কাছের স্ত্রী জোছনা এ নিয়ে তামাসা করতো। রঙ্গ করে বলতো :
-ঐ মিয়া, বউ পাগলা অইছ বুঝি ?
-বউরে ছাড়া দেহি কিচ্ছু বুঝো না।
-আহ্ হা রে, সাধের যৌইবন ভাটায় গেল তোমার মতন একখান নাগর পাইলাম না।
শমসের হাসতে হাসতে বলতো:
-পাইলে কী করতা, ভাউজ ?
-গলায় ঝুইলা পড়তাম। বোষ্টমী অইয়া দেশান্তর যাইতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ত জোছনা। আমিরন এসে একহাল হাসি দিতো। বলতো :
-বুবু,পুরুষ মাইনষেরে এত বিশ্বাস করন ঠিক না। হেগোর ভালোবাসা অইল গিয়া কচু পাতারপানি।
সত্যিই শমসেরের ভালোবাসা আমিরনের প্রতি কখন যে ফিকে হয়ে পড়েছিল আমিরন তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারলো, তখন আর আমিরনের করার কিছু ছিল না।আমিরনের বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে ক্ষত বিক্ষত করে শমসের আক্কাছের স্ত্রী জোছনাকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
আমিরনের আর বাপের বাড়ি ফেরা হয় না। তার বাবা দবির শেখকে সে চেনে। কেটে ভাসিয়ে দেবে নদীর জলে তবু তাকে ঘরে তুলবে না। আমিরন কাজ খুঁজতে থাকে। খুলনাশহরের পথ ধরে সারাদিন সে ঘোরে, কিন্তু কে তাকে কাজ দেবে ? এ শহর তার অপরিচিত। জানা শোনা কিংবা আত্মীয় পরিজন বলতে তেমন কেউ নেই। তবে ঢাকায় তার গ্রামের এক চেনা জানা লোক আছে। তার কাছে গেলে নিশ্চই ফেলে দেবে না।
অনেক আশা নিয়ে আমিরন ঢাকায় আসে। তাকে দেখে আজগর মিয়া প্রথমে বিরক্ত হলেও কি ভেবে তাকে থাকতে দেয়। বউকে বুঝিয়ে বলে :
-বউ, আমিরন আমরার গেরামের দবির চাচার মাইয়্যা, বিপদে পইড়া আইছে। অহন কি করি ক দেহি ?
আজগর মিয়ার বউ কুসুমকোনো কথা বলে না। গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে। অভাবের সংসারে এই আপদ সহ্য করা কি করে তার পক্ষে সম্ভব?
আজগর মিয়া আর তার বউ কুসুম গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে পোশাক কারখানায় কাজ করে। তিন ছেলে মেয়ে গ্রামে তার শাশুড়ির কাছে থেকে লেখা পড়া করে। দু’জনের রোজগারে ভালোই চলছিল তাদের সংসার, কিন্তু হঠাৎ আমিরনের উপস্থিতি কুসুম মেনেিেত পারে না। তাছাড়া আজগর মিয়ার চলফেরাও খুব সুবিধার মনে হয় না। ইদানীং আজগর নানা ছুতোয় অফিস কামাই দেয়। চাকরি দেয়ার নাম করে সারা দিন আমিরনকে নিয়ে টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। আজগর মিয়ার এই ভিমরতি কুসুমের ভালোলগেনা।
আমিরনের কোনো দোষ ছিল না। সুযোগ পেলেই আজগর কাছে ভেড়ার চেষ্টা করতো। আমিরনের কচি লাউয়ের ডগার মতন নয়ালি যৌবন আজগরকে অন্ধ করে দেয়। তাই আজগর ধর্ম সমাজ সংসার সব ছেড়ে আমিরনকে পেতে চায়। আমিরনকে ছাড়া আজগরের কিছুতেই চলতে পারে না। সে সুযোগ পেলেই ক্ষুধার্ত বাঘের মতন আমিরনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। একসময় আমিরন টের পায় সে অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান নষ্ট করার চাপ দেয় আজগর আলী। আমিরন তাতে রাজি হয় না। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আমিরনকে নিয়ে আজগর পালিয়ে যায়। বিয়ে করে নতুন সংসার বাঁধে। শহরতলিতে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নেয়। আমিরন ফুটফুটে এক কন্যা প্রসব করে। কন্যারনাম রাখে অশ্রু। নিদারুণ দুঃসময়ে তার জন্ম। তাই অশ্রু নামটি মন্দ হয়নি। আজগর মিয়া আবার নতুন কারখানায়কাজ নেয়। আমিরন সারাদিন সংসার সামলায়। দিন কেটে যায়। বছর গড়ায়। আজগর মিয়ার মন থেকেও আমিরন অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে থাকে। একদিন কোনো কিছু না বলেই আজগর আমিরন আর অশ্রুকে রেখে চলে যায়। অনেক খুঁজেও আর তার হদিস পাওয়া যায় না।
আমিরন নির্দয় ঢাকা শহরে কচুরি পানার মতোভাসতে থাকে। সে তার নিজের জন্য ভাবে না। তার ভাবনা হলো মেয়ের জন্য। প্রতিবেশি ফুলভানু তাকে পরামর্শ দেয় কিছু করার, কিন্তু করবে সে খুঁজে পায় না। অবশেষে ফুলভানু একদিন আমিরনকে বলে :
-ভাবী, চলো তোমারে এক যায়গায় লইয়া যাই। কামে লাগাইয়া দেই, মেলা টেহা পাইবা। তোমার সংসারে আর অভাব থাকবো না।
-কোনহানে লইয়া যাইবা ?
-কী কাম, কও দেহি বইন ?
-অহন কমু না, আগে আমার লগে লো।চ তোমার মাইয়্যারে নিয়া চিন্তা করন লাগবো না, উড়ে আমার খালার কাছে রাইখ্যা যামু।
অভাবের তাড়নায় ফুলভানুর সাথেকাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে আমিরন। ফুলভানু তাকে একটা অপরিচিত যায়গায় নিয়ে আসে। সেখানকার লোকগুলোর চাহনি অসহ্য ঠ্যাকে আমিরনের। কিছু বুঝে ওঠবার আগেই মোটা মতন একটা লোক প্রায় জোর করে আমিরনকে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। প্রায় আধ ঘণ্টা পর লোকটি চলে গেলে আরেকজন আসে আমিরনের কাছে। এভাবে সন্ধ্যা অবধি চলতে থাকে। রাতে শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে আমিরন ঘরে ফিরে আসে।
আমিরনের আদি অন্তহীন নিরুৎসবজীবন এভাবেই চলতে থাকে। তারপর আমিরনের কষ্টের জীবনের যবনিকা দূর করতে আসে অন্য আরেক পুরুষ। তার পাশের গ্রামের আয়ুবব্যাপারীর ছেলে কোরবান আলী। কোরবান আলী ঢাকায় অটোরিকসা চালায়। থাকে আমিরনের পাশের ঘরেই। আমিরনকে তার খুবভালো লাগে। বিয়ে করার টোপ ফেলে। আজীবন সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। কোরবান আলীরও অল্প দিনের ব্যবধানে দু’টি বউ চলে গেছে পরপারে। তাই ভগ্ন হৃদয় কোরবান আলীর প্রস্তাব আমিরন ফেলতে পারেনি। কোরবান আলীকে বিশ্বাস করে পুনরায় নতুনজীবন শুরু করে আমিরন।
প্রথম প্রথম আমিরন ভেবেছিল হয়ত কোরবান আলী তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। তাকে নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে, দিয়েছে অনাবিল জীবনের প্রতিশ্রুতি।কিছুদিনের মধ্যে তারভুল ভাঙে। কোরবান আলীর আসল চেহেরা উন্মুক্ত হয়।আমিরনের সাথে জানোয়ারের মতন আচরণ করে কোরবান। যখন তখন গায়ে হাত তোলে। আমিরনকে ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। মেয়ের সামনে আমিরনকে গরুর মতন পেটাতে থাকে। আমিরন কেবল গোপনে কাঁদতে থাকে। কান্না ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে তার।
ফুলভানুর সাথে কোরবান আলীরঘনিষ্ঠতা বাড়ে। রাত বিরাতে কোরবান ফুলবানুর ঘরে ঢোকে। আমিরন দেখে চেয়ে চেয়ে। চোখে ভাব নেই। কে যেন আমিরনের চোখ দুটো কেড়ে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে এক জোড়া পাথুরে চোখ।
আমিরনের কাছে দুনিয়াটা বিস্বাদ মনে হয়। তাই সে আত্মঘাতিনী হওয়ার চরম সিদ্ধান্তটি বেছে নেয়। ঘরে সিলিং ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় বেঁধে যখন ঝুলতে যায় আমিরন, তখন অশ্রুর শুষ্ক মলিন মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। গভীর জীবনাসক্তি তাকে ফিরিয়ে আনে সুনিশ্চিত মরণের গহীন গহ্বর থেকে। বিছানায় কান্নারত মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকে আমিরন। কি আশ্চর্য মুহূর্তেই মেয়েটি যেন তার সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা মুছে দিয়ে তাকে নিয়ে যায় অলৌকিক মায়াবী দেশে।
শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর, শিক্ষক (বাংলা), সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, সাভার, ঢাকা