সরকারিভাবে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। সরকারের সংগ্রহ নীতিমালা অনুযায়ী গুদামে সব সময় কমপক্ষে ১০ লাখ টন চাল মজুদ থাকার কথা। আর বিশেষজ্ঞদের মতে, মজুদ থাকা উচিত ১৫ লাখ টন। কিন্তু এখন সরকারের কাছে মাত্র ২ লাখ ৯৭ হাজার টন চাল মজুদ আছে। ওই ঘাটতি পূরণে সরকার আমদানির মাধ্যমে চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। বেসরকারিভাবে সাড়ে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন হলেও সাড়ে ৭ লাখ টনেরও কম চাল দেশে এসেছে। আর সরকারিভাবে সাড়ে ১০ লাখ টন লক্ষ্য থাকলেও আমদানি করা হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন। ফলে বিশাল ওই ঘাটতির কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং চাল ব্যবসায় সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নতুন ধান উৎপাদন হওয়ার পরও দেশে চালের দাম না কমে বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে। গত এক বছরে দেশের খুচরা বাজারে চালের দাম প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন সরকার দেশের কৃষক ও মিল মালিকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তবে তা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সরকার গত ২৭ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে চাল আমদানির শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। তারপর ব্যবসায়ীরা ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৩ টন চাল আমদানির অনুমোদন নেয়। কিন্তু আমদানির শেষ দিন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩০ টন চাল প্রবেশ করেছে। যা অনুমোদনের ৪৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বেসরকারি চাল আমদানিকারকরা অনুমতি নেয়ার পরও প্রায় ৫২ ভাগ চাল আমদানি করেনি। তাছাড়া ২ লাখ ১০ হাজার ৭৬১ টন চালের এলসি খোলার পরও আমদানি করা হয়নি। আর আমদানিকারকরা ৬ লাখ ৫ হাজার ৬৭২ টন চালের এলসি খোলেনি। ফলে ভেস্তে গেছে আমদানির মাধ্যমে চালের ঘাটতি পূরণের সরকারি উদ্যোগও।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী গত বছরের আগস্টেই প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা সত্ত্বেও খাদ্য মন্ত্রণালয় ৪ মাস পর গত জানুয়ারিতে ওই প্রক্রিয়া শুরু করে। তারপর নানা জটিলতায় বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতেও বিলম্ব হয়েছে। তাছাড়া গত বোরো মৌসুমে সরকারের ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ লাখ টন। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ টন সংগ্রহ হয়েছিল। সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। তার মধ্যে সংগ্রহ হয়েছিল ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০ টন। আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় লাখ টন আর সংগ্রহ হয়েছিল ৯৯ হাজার ১২৩ টন। একইভাবে আমন মৌসুমেও সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি সরকার। চলতি বোরো মৌসুমে সরকার সাড়ে ৬ লাখ টন ধান কিনতে চায়। যা গত বছরের চেয়ে সাড়ে ৩ লাখ টন কম। তাছাড়া সাড়ে ১১ লাখ টন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। তবে বেশিরভাগ জেলায় এখনো তা শুরু হয়নি। আর ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়ে শেষ হবে ৩১ আগস্ট। গত দুই মৌসুমে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় খাদ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছিলেন, চালকল মালিকরা যদি সিন্ডিকেট করে তাহলে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে। কিন্তু সেই আমদানির উদ্যোগ সফল হয়নি। এখন আবার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহের জন্য সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে সরকার। গত ৪ মে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের এবং ৫ মে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ওই সময় চলতি বোরো মৌসুমে ধান-চাল ক্রয়ের গতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।
সূত্র আরো জানায়, কভিডের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনা অনেক কঠিন। প্রতিটি দেশই তাদের নিজস্ব খাদ্য মজুদ রেখেছে। আর দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে মাসে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টন চাল আমদানি করা যায়। অথচ দেশে প্রতিদিন চালের চাহিদা ৮০ হাজার টন। এমন অবস্থায় আমদানির চেয়ে সংগ্রহের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে দেশের বাজারে চালের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি না করে উন্মুক্তভাবে সুযোগ দিয়ে মনিটরিং বাড়ালেই অভিযান সফল হতো। আর প্রয়োজনীয় চাল আমদানি হলেই তা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারতো সরকার।
এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, বেসরকারিভাবে আমদানি না করে সরকারকে নিজে চাল আমদানি করতে হবে। কিন্তু সরকার নিজে যে পরিমাণ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও আনতে পারেনি। সংগ্রহ ও আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় বাজারে চালের দামে ঊর্ধ্বগতি রয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে কোনো কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে চালের বাজারে আরো ঊর্ধ্বগতি দেখা দেবে। করোনা পরিস্থিতিতে এক বছরে চালের মজুদ ১১ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে ১৫ লাখ টন করা জরুরি ছিল। কিন্তু তা না করে মজুদ ২ লাখ টনে নামিয়ে আনা হলো।
অন্যদিকে চাল আমদানিকারকরা জানান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পুরো চাল আমদানি করা সম্ভব হয়নি। বলা হয়েছে ৭ দিনের মধ্যে এলসি খুলতে হবে। আর চাল আনার পর ২০ দিনের মধ্যে বাজারজাত করতে হবে। ওই অল্প সময়ের মধ্যে চাল নিয়ে আসা অনেক কঠিন। আবার বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আমদানি নিয়ে সংশয়ে পড়ে। তাছাড়া সীমান্তে ট্রাকে ও কাস্টমসে হয়রানির কারণেও অনেকে এলসি খোলার পরও দেশে চাল আনতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যসচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, আমদানিকারকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রয়েছে। সেজন্য তাদের চাপ দেয়া যায় না। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য ৩২০ আমদানিকারককে নির্দিষ্ট পরিমাণে চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এখন বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। চাল আমদানির আর প্রয়োজন নেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে ২ কোটি ৫ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। সেজন্য অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারপরও সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে শুল্ক কমিয়ে আবার আমদানির উদ্যোগ নেয়া হবে। আর সরকারিভাবে ১৩ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে।