গত ১৭ মে সোমবার, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পার হলো। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার সময় স্বামীর চাকরিসূত্রে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। স্বামী-সন্তানের পাশাপাশি ছোট বোন শেখ রেহানাও ওই সময় তার সঙ্গে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তারা। এরপর ৬ বছর এদেশে-ওদেশে কাটিয়ে দেন শেখ হাসিনা-ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া দম্পতি। দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন জীবনের ইতি টেনে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরেন। এদিন তাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ভারতের দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে বিকালে ঢাকায় নামলে বিমানবন্দরে লাখো মানুষ তাকে স্বাগত জানান।
দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছর আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু এ বছর বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে সৃষ্ট সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে সব ধরনের জনসমাগমপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহার করে আসছে দলটি। ফলে ঘরে বসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশবাসীকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনায় পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করার আহ্বান জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
তবে এ বছর দিবসকে ঘিরে বিটিভিতে পর্দায় ফিরে এলো ডকুড্রামা ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল'। সারা দেশে সিনেমা হলে এবং টেলিভিশনে দারুণ জনপ্রিয়তা পাওয়া এবং আন্তর্জাতিক বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল’ ডকুড্রামাটি ১৭ মে বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে সম্প্রচার হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডসহ বেশ কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে।
জানা যায়, স্টার সিনেপ্লেক্সে গত ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রিমিয়ার শো’র মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ‘হাসিনা : এ ডটার’স টেল।’ দর্শকদের জন্য স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার সিনেমায়, মধুমিতা সিনেমা হল এবং সিলভার স্ক্রিনে প্রদর্শনী শুরু হওয়ার পর থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহে বক্স অফিসে সবচাইতে সফল ছিলো ডকুড্রামাটি। দর্শক চাহিদার কথা মাথায় রেখে পরবর্তীতে সারা দেশের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের আরো ৩৫টি সিনেমা হলে প্রদর্শন করা হয় ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল' ডকুড্রামা। সব মিলিয়ে দারুণভাবে ব্যবসায় সফল এটি।
শেখ হাসিনার জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল’ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও নসরুল হামিদ বিপুর প্রযোজনায় ডকুড্রামাটি পরিচালনা করেছেন অ্যাপল বক্স ফিল্মসের পিপলু খান। এতে শেখ হাসিনাকে স্বভূমিকায় নামচরিত্রে এবং তার বোন শেখ রেহানাকে তার স্বভূমিকায় দেখা যায়।
ডকুড্রামায় একজন শেখ হাসিনার রান্না ঘর থেকে শুরু করে সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন, বেঁচে থাকার সংগ্রামসহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক জীবনের নানা দিক ফুটে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানার জীবনের কথাও উঠে এসেছে এতে। এই ডকুড্রামার মধ্য দিয়ে একটি সত্যনিষ্ঠ জীবন প্রবাহকে পর্দায় হাজির করতে চেয়েছি।
দেশে ফেরার আগেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকাস্থ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত দলটির জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে তার অনুপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে দল পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব দেন নেতাকর্মীরা। পরে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে আসেন শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালে ওই দিনটি ছিল রোববার। সারা দেশ থেকে আসা লাখো মানুষ সেদিন তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান, ভালোবাসায় সিক্ত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত মানুষের ঢল নামে।
লাখো জনতার সংবর্ধনার জবাবে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছিলেন, 'আমার আর হারানোর কিছুই নেই। বাবা-মা, ছোট ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে বাংলার দুখি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।'
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পথও মসৃণ ছিল না। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে তাকে। শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কখনও নিজ বাসভবনে, কখনও জনসভায় আবার কখনও তার গাড়িবহরে- ক্ষমতায় যাতে শেখ হাসিনা কোনোভাবে যেতে না পারেন।
আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা সামনে সারিতে থেকে নেতৃত্বে দেন। সর্বোচ্চ ত্যাগও করতে হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে। কিন্তু শেষাবধি আন্দোলনের ফসল তার ঘরে যায়নি। একানব্বইয়ে জাতীয় নির্বাচনে তার দল পরাজয় বরণ করে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন দাবিতে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ কাঁপিয়ে দেন তিনি। এ আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বারের মতো শপথ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এরপর ২০০৮ সালে নবম, ২০১৪ সালে দশম এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে অধ্যবধি স্বপদে আসীন রয়েছেন মাননীয় শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। বরং নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। সেদিনের মেঘের গর্জন, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল। অবিরাম মুষলধারে ভারী বর্ষণে যেনো ধুয়ে-মুছে যাচ্ছিল বাংলার মাটিতে অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীনতার অমর নায়কহত্যার জমাট বাঁধা পাপ আর কলঙ্কের চিহ্ন। রাজনৈতিক বাকপরিবর্নে ক্ষমতার পালাবদল হলেও ইতিহাস ভুলবার নয়। বরং সময়-সুযোগ পেলেই ইতিহাস প্রতিশোধ নিতে কখনো ভুল করে না। সুতরাং সাবধান 'ঈমানদার'।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, কলামিস্ট ও দৈনিক সংবাদের সাবেক সহসম্পাদক)