দেশে দিন অবৈধভাবে উৎপাদিত নিম্নমানের সিগারেটের বাজার প্রসারিত হচ্ছে। আর অবৈধভাবে উৎপাদিত সিগারেট থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবৈধভাবে উৎপাদিত সিগারেট বেশি বিক্রি হচ্ছে। ওসব সিগারেট সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় কম দামে বিক্রি হওয়ায় ক্রেতারাও আকৃষ্ট হচ্ছে। মূলত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির ঘাটতির সুযোগে এমন অবস্থা হচ্ছে। তবে করোনা মহামারীর কারণে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়লেও সিগারেট খাতের রাজস্বে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি বছর সিগারেট খাত থেকে প্রায় ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছরই বাজেটে সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করা হয়। আর এই সুযোগে বেড়ে চলেছে অবৈধ সিগারেটের বাজার। ব্যবসায়ীরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন করছে আর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে বিক্রির জন্য বেছে নিচ্ছে। কারণ সেখানে পুলিশ বা রাজস্ব কর্মকর্তাদের নজরদারি ও অভিযান নেই। দেশে সর্বনিম্ন ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৩৯ টাকা নির্ধারিত। কিন্তু ওসব বাজারে ২০-২৫ টাকায় এক প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। আর কম দামে বিক্রির মূলে রয়েছে রাজস্ব ফাঁকি।
সূত্র জানায়, সরকার সিগারেটের মূল্য থেকে গড়ে প্রায় ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব আয় করে থাকে। যার মধ্যে আছে সম্পূরক শুল্ক, মূল্যসংযোজন কর ও হেলথ সারচার্জ। কিন্তু অসাধু উৎপাদনকারীরা সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে নকল ব্যান্ডরোল/ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার করার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেয়। দেশের বাজারে নিম্নস্তরের সিগারেট উৎপাদনকারী ২৫টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে তার মধ্যে আইন মেনে নির্ধারিত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে মাত্র ৩টি প্রতিষ্ঠান। বাকি উৎপাদকরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বিপণন করে। ওসব প্রতিষ্ঠান কেবল রাজস্বই ফাঁকি দেয় না, বরং অনিয়মতান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিগত ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র ছাড়া সিগারেট উৎপাদনের অভিযোগে চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করে। কিন্তু জরিমানা পরিশোধ না করে আরো বৃহৎ পরিসরে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ায় গত বছর প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানের সিনেমা হল, রাইস মিল, তেলের মিলের আড়ালে এবং জনবসতিপূর্ণ স্থানে আইনের তোয়াক্কা না করে মানহীন অবৈধ সিগারেটের উৎপাদন চলে। আর পরিবহনে ভ্যাট চালান বাধ্যতামূলক হলেও কুরিয়ার সার্ভিসে ওসব অবৈধ সিগারেট পরিবহন করা হয়। চারটি মূল্য স্তরের মধ্যে শুধু নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তাই প্রায় ৭০ শতাংশ।
সূত্র আরো জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেটের প্রসার ঘটে। ওই অর্থবছরে এনবিআরের প্রায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। ওই রকম রাজস্ব ফাঁকি এড়াতে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সহনীয় পর্যায়ে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এদিকে তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তা সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ। মহামারীর কারণে এমনিতেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, এমন অবস্থায় সিগারেটের দাম বৃদ্ধি পেলে নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তারা কম দামি অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকবে। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বাড়বে। পাশাপাশি বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। সেক্ষেত্রে উৎসাহ পাবে কর ফাঁকি দেয়া সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
অন্যদিকে এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মতে, কর ফাঁকি দিয়ে যেসব সিগারেট চোরাচালান হয়ে আসে, সেগুলো অবৈধ। আর দেশের ভেতরেই অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান সিগারেট উৎপাদন করলেও তারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। কোনো ধরনের লাইসেন্স নেই। সেগুলোও অবৈধ সিগারেট। তাছাড়া ধোঁয়াহীন তামাক, যেমন জর্দ্দা, গুল, ওসবও কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই তৈরি ও বাজারজাত হয়। আসলে পুরো বিষয়টাই করজালের বাইরে রয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে যে কর আইন আছে সেগুলোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।