করোনা মহামারির কারণে গত বছরের (২০২০) লকডাউনে দুধ নিয়ে চরম দুর্দশায় পড়েছিলেন পাবনার বেড়ার খামারিরা। দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা কমিয়ে দেওয়ায় খোলা বাজারে পানির দরে দুধ বেচতে হয়েছিল তাঁদেরকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ননি তুলে রেখে ননিবিহীন দুধ ফেলে দিতেও হয়েছিল। এভাবে গত বছরের মার্চ থেকে শুরু করে টানা চার-পাঁচ মাস খামারিদের ব্যাপক লোকসান দিতে হয়েছিল। কিন্তু এবারের লকডাউনে দুধ বিক্রিতে গতবারের উল্টো চিত্র দেখা দিয়েছে। এবার দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছে ধরনা দিয়ে ও দাম বাড়িয়েও প্রয়োজনীয় দুধ পাচ্ছে না। খামারিরা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে খোলা বাজারে ও ছানা তৈরির কারখানায় চড়া দামে দুধ বিক্রি করছেন। এ অবস্থায় করোনার লকডাউনের মধ্যেও দারুণ খুশি খামারিরা।
গরুর দুধের ওপর নির্ভর করে এলাকার গড়ে উঠেছে সরকারি মিল্ক ভিটা এবং বেসরকারি প্রাণ ডেইরি, আড়ং দুধ, ফার্ম ফ্রেস, পিউরা মিল্ক, ইছামতি ডেইরি, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরিসহ বেশ কিছু দুধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান। উৎপাদিত দুধের বেশির ভাগই এসব প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করে সারা দেশে বিপণন করা হয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিলে পানির দরে খোলা বাজারে দুধ বেচতে হয় খামারিদের।
খামারিরা জানান, সরকার এবার লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পর খামারিদের মধ্যে ব্যাপক দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছিল। কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন এবারও গত বছরের মতো ব্যাপক লোকসান দিয়ে দুধ বিক্রি করতে হবে। কিন্তু এবারে লকডাউনের পরে কঠোর লকডাউন এসেছে, অথচ দুধের চাহিদা না কমে উল্টো বেড়েছে। খামারিদের মতে রমজান মাস ও ঈদের কারণে স্থানীয় ছানা তৈরির কারখানা, হোটেল এবং খোলাবাজারে দুধের চাহিদা ও দাম ব্যাপক বেড়েছে। এর সঙ্গে সারা দেশে চাহিদা বাড়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোও দুধ সংগ্রহের পরিমাণ ও দাম বাড়িয়েছে। এর ফলে সব মিলিয়ে খামারিদের দুধ বিক্রিতে ভালো লাভ হচ্ছে।
খামারি ও দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, গোখাদ্যের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় অনেক খামারিই গাভিগুলোকে পরিপূর্ণ খাবার দিতে পারছেন না। এতে দুধের উৎপাদন কমেছে। কেউ কেউ আবার চড়া গোখাদ্যের কারণে গাভির সংখ্যাও কমিয়েছেন। এ ছাড়া বছরের এ সময়ে এমনিতেই গাভির দুধ দেওয়ার ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়।
বেড়া পৌর এলাকার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মীনা বলেন, ‘আমার খামারে প্রতিদিন ২৫০ লিটার দুধ হয়। দুই-তিন সপ্তাহ আগেও একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৪৮ টাকা লিটার দরে ১৫০ লিটার দুধ দিতাম। এখন ওই প্রতিষ্ঠানে দুধ না দিয়ে পুরোটাই স্থানীয় হোটেল ও খোলা বাজার ৭০ থেকে ৮০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছি। গোখাদ্যের দাম বাড়লেও এমন দামে আমরা (খামারিরা) বেশ খুশি।’
প্রাণ ডেইরির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ইফতিখারুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউনের আগে থেকেই আমরা চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাচ্ছিলাম না। প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ লিটারের জায়গায় দুধ পাচ্ছিলাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার লিটার মাত্র। এর মধ্যে আমরা দুধের দামও বেশ বাড়িয়েছি। তার পরেও গত দুদিন ধরে দুধ প্রায় পাচ্ছিই না বলা চলে।’
বেড়া পৌরসভার আমাইকোলা গ্রামে অবস্থিত আরেক দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান পিউরা মিল্কের মালিক আবদুর রউফ বলেন, ‘গতবারের লকডাউনের সময় অনেক খামারি দুধ ফেলে পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু এবার আমরা দুধের দাম লিটারে আট থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে ও খামারিদের কাছে ধরনা দিয়েও দুধ পাচ্ছি না। দুধের এত দাম জীবনে দেখিনি। আমার প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন কমপেক্ষ ১২ হাজার লিটার দুধের চাহিদা থাকলেও কোনো দুধই পাচ্ছি না।’
এদিকে বেড়ায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ছানা তৈরির কারখানা। এসব কারখানাতেও ছানার চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। খামারিরা লকডাউনের শুরুতে কারখানাগুলোতে ৪৬ থেকে ৫২ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করলেও এখন সেখানে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
বেড়া পৌরসভার আমাইকোলা গ্রামের একটি ছানা তৈরির কারখানার ব্যবস্থাপক ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘লকডাউন নিয়্যা ভয়ে ছিল্যাম। কিন্তু এবার দুধ ও ছানা দুটারই চাহিদা বাড়িছে। এখন আমরা লিটারে আট থেকে ১০ টাকা দাম বাড়ায়াও প্রয়োজনীয় দুধ পাতেছি না।’