ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ও পূর্ণিমার প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে পানি বাড়ছে। এ কারণে প্লাবিত হচ্ছে উপকূলের অসংখ্য গ্রাম। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার হাজারও মানুষ। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন।
লোকালয়ে নোনা পানি প্রবেশ করায় ডুবে গেছে আবাদি জমি, বাড়ির আঙিনা, সবজি ক্ষেত ও পুকুর। দেখা দিয়েছে, গো-খাদ্য ও মিঠাপানির সংকট। কোথাও কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোথাও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।
মঙ্গলবার বিকেল সোয়া ৩টায় আবহাওয়া কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ আবিদ হোসেন বলেন, ‘এখন পূর্ণিমার তিথি চলছে। এর মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আসছে। স্বাভাবিক কারণেই পূর্ণিমার সময়ে ঘূর্ণিঝড় হলে তাতে পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। এবারও তাই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং এরইমধ্যে উপকূলের নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে পানি ঢুকছে।’
‘এই ধরনের অবস্থায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে চার থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। উপকূল থেকে আমাদের কাছে প্লাবিত হওয়ার খবর আসছে। সময় যত বাড়বে পানিও তত বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে’, যোগ করেন এই আবহাওয়াবিদ।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
বরগুনা : অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে বরগুনার নদ-নদীতে বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার হাজারও মানুষ। স্বল্প উচ্চতার বেড়িবাঁধের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজুক বাঁধের কারণে এসব এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এ ছাড়া উঁচু জোয়ারের কারণে বরগুনার বাইনচটকি, বড়ইতলা ও পুরাকাটা ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কসহ গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফেরি চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে বরগুনার পশ্চিম গুলবুনিয়া, বড়ইতলা ও ঢালভাঙা এলাকায় ঘুরে দেখা দেছে, এসব এলাকার নদীর তীরের লোকালয় সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। ভেসে গেছে এসব এলাকার বেশ কিছু পুকুরের মাছ।
পাথরঘাটা পূর্ব রূপদোন এলাকার বাসিন্দা মো. শামসুল হক বলেন, এই এলাকায় জোয়ারের চাপে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধসে পড়েছে। এতে তাঁর বসবাসের ঘরটিও ধসে গেছে।
বড়ইতলা এলাকার বাসিন্দা মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘উঁচু জোয়ার হলে আমাদের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় এসব এলাকার হাজারও মানুষের ঘরে আজ রান্না হবে না।’
পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামের বাসিন্দা হিরা জানান, বরগুনা জেলার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে পদ্মা এলাকা। এখানে কোনো বেড়িবাঁধ নেই। জিও ব্যাগ দিয়ে এখানে নদীর পানির প্রবাহ প্রতিহতের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তা কোনো কাজে আসছে না। এখান থেকে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে অন্তত সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে ফসলের মাঠসহ পুকুর ও মাছের ঘের।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বরগুনা জেলায় ২২টি পোল্ডারে ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে জেলার ২৯ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।
বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক মো. মাহতাব হোসেন বলেন, ‘বরগুনার নদ-নদীতে আজ তিন দশমিক ৩২ মিটার উচ্চতায় জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়েছে, যা বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপরে।’
এ বিষয়ে বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইসার আলম বলেন, ‘জেলার বিভিন্ন স্থানে ২৯ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। উঁচু জোয়ারের কারণে এসব বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এ ছাড়াও উঁচু জোয়ারের কারণে বাঁধের বাইরের এলাকাগুলোও প্লাবিত হয়েছে।’
পটুয়াখালী : পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে লালুয়া ইউনিয়নের নয়টি গ্রাম। ভেঙে যাওয়া বাঁধের চারটি অংশ দিয়ে দুই দফায় রাবনাবাদ নদীর জোয়ারের নোনা পানি প্রবেশ করায় ডুবে গেছে চারিপাড়া, ধঞ্জুপাড়া, বানাতিপাড়া, পশরবুনিয়া, চৌধুরীপাড়ার আবাদি জমি, বাড়ির আঙিনা, সবজি ক্ষেত ও পুকুর। নোনা পানিতে ব্যাহত হচ্ছে দৈনন্দিন কাজ। ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত। দেখা দিয়েছে, গো-খাদ্য ও মিঠাপানির সংকট।
এদিকে পানিবাহিত রোগের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে নয়টি গ্রামের ১০ হাজার মানুষ। কৃষি নির্ভরশীল পরিবারগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা আর উৎকণ্ঠা।
কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জানান, পশরবুনিয়া ও চারিপাড়া বাঁধের ভাঙনে চারটি অংশ মেরামতের কোনো পরিকল্পনা বর্তমানে নেই।
এদিকে, রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ মিটার বাজার এলাকায় বেড়িবাঁধ ছুটে লোকালয়ে পানি ঢুকছে।
মোংলা : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাবে মঙ্গলবার সকাল থেকে মোংলা বন্দরসহ সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। এর সঙ্গে বইছে হালকা বাতাস। তবে বৃষ্টিপাত নেই। এর আগে সোমবার রাতে এ এলাকায় দুই দফায় কয়েক মিনিটের গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয়েছে।
এখন পর্যন্ত মোংলা বন্দর, পৌর শহরসহ উপকূলের বাসিন্দাদের জনজীবন স্বাভাবিক রয়েছে। তবে অধিক ঝুঁকি ও আতঙ্কে রয়েছে মোংলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত কানাইনগর, চিলা ও জয়মনি এলাকার নদীর পাড়ের মানুষেরা। অবশ্য তাদের মধ্যে রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতিও।
ইকরাম চৌধুরী টিপু, কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। এরইমধ্যে ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় গত ২০ মে থেকে মৎস্য আহরণের সব নৌযান নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় কক্সবাজার জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক ভার্চুয়াল প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম চালু, উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক যানবাহন ও নৌযান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন।
ডিসি মামুনুর রশীদ আরও জানান, মানুষ ও গবাদি পশুর আশ্রয়ের জন্য জেলার ৫৭৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও ২৫টি ‘মুজিব কেল্লা’ প্রস্তুত রাখতে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে।
এদিকে, গতকাল সন্ধ্যা থেকে সাগর প্রচ- উত্তাল হয়ে ওঠায় এবং প্রচ- ঝড়ো বাতাস বয়ে যাওয়ায় দুবলা সাইক্লোন শেল্টার সেন্টারসহ কোস্টগার্ডের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ ছাড়া, নতুন করে সতর্ক সংকেত না বাড়ায় এবং আবহাওয়া খুব বেশি খারাপ না হওয়ায় মোংলা বন্দরে অবস্থানরত ১১টি বিদেশি জাহাজের পণ্য ওঠানামা ও পরিবহণের কাজ স্বাভাবিক রয়েছে।
বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফখরউদ্দীন বলেন, ‘সতর্ক সংকেত ৪ নম্বর না হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে। ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি কিংবা বেশি হলেই সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
এদিকে, মঙ্গলবার সকালে আবহাওয়া কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে আঘাত হানার আশঙ্কা ক্ষীণ।
আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন আজ সকাল ১০টার দিকে বলেন, “ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িষা রাজ্যে এটি আঘাত হানতে পারে। তবে বাংলাদেশে আঘাত হানার আশঙ্কা ক্ষীণ। খুলনা উপকূলে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া সারা দেশে কমবেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে।”
আবহাওয়াবিদ আরও জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৫২৫ কিলোমিটার, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৪৯০ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৪৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। এটি আরও শক্তিমাত্রা অর্জন করতে পারে।
এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার। ঝড়ো হাওয়ার আকারে এর গতি ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া সাগর বিক্ষুব্ধ অবস্থায় রয়েছে।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থান করা সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।