শেরপুর জেলা সদরের লছমনপুর ইউনিয়নের দীঘলদি গ্রামের খেলা পাগল জহির রায়হান এবার বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দৌড়াবে টোকিও অলিম্পিকে। শেরপুরের মানুষের অহঙ্কার জহির অলিম্পিকে দৌড়াবে জেনে সবাই খুশি। সবারই প্রত্যাশা জাতীয় পর্যায়ে অনেক পুরস্কার পাওয়া জহির এবার টোকিও অলিম্পিকেও দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে।
নিজ সন্তানদের ভালভাবে লেখা পড়া করানোর জন্য স্কুল শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের দীঘলদি গ্রামের বাড়ী ছেড়ে বসবাস শুরু করেন শেরপুর জেলা শহরের বারই পাড়া মহল্লায়। শহরের একটি বেসরকারী স্কুলে ভর্তি করান বড় ছেলে রাসেল ও দ্বিতীয় ছেলে জহির রায়হানকে। বড় ছেলে রাসেল নিয়মিত স্কুল করলেও ৩য় শ্রেণীতে ওঠার পর খেলা-ধুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে জহির রায়হান। স্কুলেও উপস্থিত থাকতো অনিয়মিত। প্রথমে বাবা মা বকাবকি করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে ফুটবল অনুশীলণ করার জন্য ভর্তি করায় “ফর ফুটবল শেরপুর” এর কোচ সাধান বসাকের কাছে। সেখানে সে ভাল ফুটবলার হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়।
পরবর্তীতে বিকেএসপি প্রতিভা অন্বেষণ টিম আসে শেরপুরে খেলোয়ার বাছাই করার জন্য। প্রথম বার বিকেএসপিতে জায়গা না করতে পারলেও পরেরবার ২০১২ সালে এথলেটিক খেলোয়ার হিসেবে বিকেএসপিতে সুযোগ করে নেন জহির। সেখানে প্রথমে একমাস প্রশিক্ষন করে বাছাইয়ে টিকে যান, এবং আবারও ৫দিনের প্রশিক্ষন দিয়ে বিকেএসপিতে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পান জহির। এরপর থেকেই তার সমানে চলা।জহির রায়হান দেশের বড়বড় আসরে অনেক পুরস্কার জিতেছেন। ৪০০ মিটারে ৪৬.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে দেশীয় আসরে ৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড ২০১৭ সালের ইয়ুথ অ্যাথলেটিকস, নাইরোবি, কেনিয়া ও এশিয়ান ইয়ুথ অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ, থাইল্যান্ড এ ৪০০মি. ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে হিটে উত্তীর্ণ হয়ে সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় সাউথ এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপ, ২০১৯ সালে কাতারে ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকস, ২৩তম এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ এবং নেপালে ১৩তম সাউথ এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেন জহির। তার এ সাফল্য দেখে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে তাকে পিটি কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরী দেয়া হয়। এতে খুশি সে ও তার পরিবার।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন একজন অ্যাথলেট মনোনয়নের জন্য অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনকে চিঠি দেয়। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সিলেকশন কমিটি মনোনয়নের জন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করলে সেখান থেকে জহির রায়হানের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো পারফরমেন্সের ভিত্তিতে টোকিও অলিম্পিকের জন্য তাকে মনোনয়ন করে।
এব্যাপারে জহির রায়হান জানান, আমি ছোট থেকেই খেলা পাগল ছিলাম। প্রথমে আমার বাবা মা আমাকে লেখা পড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলেও পরবর্তীতে আমাকে সহযোগিতা করেছে আমার বাবা, মা ও পরিবারের সদস্যরা। প্রথমে ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে আমার বাবার ইচ্ছেতেই আমি এথলেটিকসে বিকেএসপিতে ভর্তি হতে সক্ষম হই। আজ আমি আমার বাবা-মার আশা পুরণ করতে পেরেছি। এজন্য আমার কোচার স্যারসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আর সবার কাছে দোয়া চাই আমি যেন টোকিও অলিম্পিকে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারি।
ছেলের সাফল্যে খুশি তারা বাবা আবদুর রাজ্জাক ও মা শিখা বেগম। বাবা আবদুর রাজ্জাক জানান, আমার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করালেও তার খেলার প্রতি টান ছিলো বেশী। তাই আমার বড় ছেলের পরামর্শে আমি তাকে খেলা ধুলার চর্চা করাতে আগ্রহী হয়ে ওঠি। কারণ আমি নিজেও এথলেটিকস ছিলাম এবং বর্তমানেও আমি একজন শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। আমার চার ছেলের মধ্যে জহির দ্বিতীয়। আমার ছেলে যাতে দেশের জন্য আরো সম্মান বয়ে আনতে পারে এ কামনাই করি। মা শিখা বেগম জানান, আমার ছেলে যাতে আরো সাফল্য অর্জন করতে পারে এজন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
জহির রায়হানের প্রথম কোচ সাধন বসাক জানান, জহির প্রথমে আমার কাছে অনুশীলন করে। তাকে অনুশীলন দেখে প্রথম থেকেই আমি ভেবেছি সে একদিন বড় কিছু করতে পারবে। আজ সেটাই বাস্তবে পরিনত হয়েছে। এতে আমি খুবই খুশি।
শেরপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সম্পাদক মানিক দত্ত জানান, শেরপুরের ক্রীড়ামোদীসহ সর্বস্তরের মানুষ খুশি জহিরের এ কৃতিত্বের জন্যে। এজন্য তাকে শেরপুর জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে সম্বর্ধনাও দেয়া হচ্ছে। জেলা ক্রীড়া সংস্থাও টোকিও অলিম্পিকে জহির ভালো করবে এ প্রত্যাশা করছে।
২৬ মে শেরপুর জেলা প্রশসানের পক্ষ থেকে জহির রায়হানকে সম্বর্ধনা ও নগদ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব বলেন, জহির আমাদের অহঙ্কার। সে শুধু শেরপুর নয় সারাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করছে। আমরা আশা করবো, টোকিও অলিম্পিকে সে দেশের জন্য আরো বড় গৌরব বয়ে আনবে।
শেরপুরের মানুষের প্রত্যাশা মাশরাফিকে দিয়ে যেমন দেশবাসী নড়াইলকে আলাদা করে চেনে, ঠিক তেমনি শেরপুর জেলাকেও জহিরকে নিয়ে ভিন্নভাবে চিনবে।