দেশে প্রতি বছরই ভাঙছে নদী, নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি-জমিজমা হারিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। এবারও বর্ষা আসার আগেই পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন। তাতে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, ফসলি-জমিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিস্তীর্ণ জনপদ। কুড়িগ্রামে তিস্তার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিরাজগঞ্জে যমুনার ভাঙনে পাল্টে যাচ্ছে জেলার মানচিত্র। পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙনের কবলে রয়েছে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। ভাঙন এলাকার মানুষের অভিযোগ, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তেমন কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেই। এবারও পুরোমাত্রায় বর্ষা আসার আগে ভাঙন রোধে পদক্ষেপ না নিলে অনেক স্থানে বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে চলে যাবে এবং গৃহহীন হবে হাজার হাজার পরিবার। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, ভাঙন প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। নদী ভাঙন এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রায় প্রতিবছরই নদী রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়। তবে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের অভিযোগ- ওসব প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে হয় না। নদী দখল-দূষণ বন্ধ করা, নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে তার ৫০ শতাংশও সঠিকভাবে ব্যয় হয় না। বরং ওসব প্রকল্পের কমপক্ষে ৭০ শতাংশই সংশ্লিষ্টদের পকেটে চলে যায়।
সূত্র জানায়, বর্ষার আগেই পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে কুড়িগ্রামে তিস্তা নদী তার ভয়ালরূপ দেখাতে শুরু করেছে। তিস্তার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ভরা বর্ষার বন্যার আগে ভাঙন রোধে পদক্ষেপ না নিলে দুই জেলার কয়েক হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাবে। কুড়িগ্রামে মেগা প্রকল্পে তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে জরুরি বরাদ্দ না থাকায় ক্ষুব্ধ তিস্তা পাড়ের মানুষ। সম্প্রতি তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে শত-শত বিঘা আবাদি জমি, গাছপালাসহ শতাধিক বাড়িঘর। ভেঙে গেছে ৪০ মিটার মূল সড়ক। বর্তমানে তিস্তার ভাঙন রোধে অস্থায়ীভাবে জিওব্যাগ এবং জিওটিউব দিয়ে রোধ করার চেষ্ঠা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর স্থায়ীভাবে কাজ করার জন্য প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ক্রমশ পানি বৃদ্ধির ফলে সিরাজগঞ্জে যমুনা ফুলে ফেঁপে উঠছে। উত্তাল যমুনা তর্জন-গর্জন করে ভাঙছে নদী। সিরাজগঞ্জে নদী তীরবর্তী সিরাজগঞ্জ সদর, শাহজাদপুর, কাজিপুর, চৌহালী, বেলকুচি ওই ৫টি উপজেলায় নদীর দু’পাশে ভাঙন শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে ভারী বর্ষণের সাথে দক্ষিণা বাতাস যুক্ত হওয়ায় ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শাহজাদপুর ও চৌহালীতে অব্যাহত ভাঙনে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে চৌহালী উপজেলা। ইতিমধ্যে চৌহালী উপজেলা ভাঙনকবলিত হয়ে টাঙ্গাইল জেলার সাথে যুক্ত হয়েছে। সেই সাথে কাজিপুরে ভাঙনের ফলে জামালপুর জেলার সাথে যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর যাবত অব্যাহত ভাঙনের মুখে পড়েছে স্কুল, কলেজ, মাদাসা, মসজিদ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট ও আবাদী জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বিশেষ করে প্রায় পাঁচশ’ কোটি ব্যয়ে নির্মিত এনায়েতপুরে খাজা ইউনুছ আলী মেডিক্যাল কলেজ ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও বৃষ্টির প্রভাবে নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদারীপুরের ৪টি উপজেলার আড়িয়াল খাঁ, পদ্মা পালরদী নদীর ভাঙনে বেশ ক্ষতি হয়েছে। থেমে থেমে নদীর ভাঙন চলমান থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও পরিবারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নদীভাঙনে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, মসজিদ, কমিউনিটি ক্লিনিক, হাটবাজার, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। তাতে করে মাদারীপুর জেলার ভৌগলিক মানচিত্র ক্রমশ পরিবর্তন হচ্ছে। ভাঙন প্রতিরোধে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু কিছু স্থানে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ফেলেছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। নদী ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিবচর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী ইউনিয়ন চরজানাজাত কাঠালবাড়ী সন্নাসিরচর বহেরাতলা। গত বছর চরজানাজাত ইউনিয়ন পরিষদের কমপ্লেক্স ভবন, চরের বাতিঘর খ্যাত বন্দরখোলা ইউনিয়নের নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩ তলা ভবন, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক ও কাজিরসূরা হাট-বাজার পদ্মা নদীতে বিলীন গেছে। এখনও পুরো এলাকা ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে। একইভাবে ভোলা জেলার সদরে শিবপুর, ধনিয়া, পূব ইলিশা কাচিয়া, রাজাপুর সদর উপজেলার বিভিন্নস্থানে মেঘনা নদী তীর ভাঙছে। চরফ্যাশনের চরমোতাহার, চর কুকরি মুকরির, ঢালচর, চরকছ্ছপিয়া, মনপুরার উত্তর সাকুচিয়া, লালমোহনের লর্ডহার্ডিঞ্জ চাঁদপুর মিয়ারহাট, তজুমুদ্দিন এর চাচড়া, গুরিন্দা এলাকায় নদীতীর ব্যাপক হারে ভাঙছে। লক্ষ্মীপুরে মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন গেছে বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও ফসলি জমিসহ রামগতি ও কমলনগ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রায় ১৫ হাজার একর ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ৫টি কলোনি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এবং কয়েক কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়কসহ অসংখ্য মসজিদ ও বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে কমলনগর উপজেলার নাছিরগঞ্জ, নবীগঞ্জ, লুধুয়া ও রামগতি উপজেলার জনতাবাজার এলাকা। হুমকির মুখে রয়েছে বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। মানিকগঞ্জে পদ্মা যমুনা নদীর তীরবর্তী মানুষ এখন ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। গত কয়েকদিনে শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলার শতাধিক পরিবারের বসতভিটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়াও ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি অন্যত্র স্থানান্তর করছে। বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়া পরিবারগুলো অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। সব চেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে হরিমারপুরের কাঞ্চপুর ইউনিয়ন ও শিবালয় উপজেলার দক্ষিণ শিবালয় এলাকায়। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় বর্ষার আগেই পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে উত্তাল ঢেউ আর প্রবল স্রােতের কারণে অসময়ের এই ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে পদ্মা নদী ঘেঁষা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ৮টি গ্রাম। ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো হচ্ছে কুমারভোগ ইউনিয়নের খড়িয়া, হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ হলদিয়া, কনকসার ইউনিয়নের সিংহেরহাটি, বেজগাঁও ইউনিয়নের সুন্দিসার; বেজগাঁও, গাওদিয়া ইউনিয়নের গাওদিয়া, শামুরবাড়ি ও কলমা ইউনিয়নের ডহরী। রংপুরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল আর ভারীবর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। ইতিমধ্যে তিস্তার পেটে বিলীন হয়ে গেছে রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার শতাধিক ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। হুমকির মুখে রয়েছে মসজিদ ও বিদ্যালয়সহ আরো অনেক স্থাপনা। ফেনী জেলার মহুরী নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের বসতবাড়ি, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট। সম্প্রতি টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের চাপে ফুলগাজী সদরের উত্তর শ্রীপুর গ্রামের নাপিত কোনা এলাকায় মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ১৫ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দেয়। মুহূর্তেই মানুষের ঘরবাড়ি, বাজারের দোকাটপাটে পানি ঢুকে পড়ছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তাঘাট, ফসলি জমি ও মাছের ঘের।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী গত চার দশকে কমবেশি এক লাখ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন নদণ্ডনদীর প্রায় ৩শ’ ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই ওসব এলাকায় কমবেশি ভাঙন দেখা দেয়। চলতি মৌসুমেও ৫২টি জেলার ২৭২টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার শরীয়তপুরের নড়িয়া এলাকায় পদ্মার ভাঙন রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; কিন্তু অন্যান্য ভাঙন এলাকার দিকে সরকারের তেমন নজর নেই। ভাঙনের এমন বিপর্যয়কে নিছক ভূমির হিসেবে দেখলে চলবে না। একেকটি ভাঙন মানে কিছু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) আশঙ্কা, দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ বছর ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। তার মধ্যে তীব্র ভাঙনের মুখে পড়তে পারে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। সিইজিআইএসের পূর্বাভাসের তালিকায় না থাকলেও শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলা গত দুই বছর তীব্র ভাঙনের মুখে রয়েছে। ওই তিন জেলায় এবারও নদী তীবরর্তী এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি গত বছর দেশের ১৩টি জেলায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করেছিল। তবে বাস্তবে ভেঙেছে ৩৮ বর্গকিলোমিটার।