মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্র্রতিরোধ করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গু জ¦রের প্রকোপ ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু জ¦র এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ¦রের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছুকিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে- যাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত পস্নাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছুকিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক- যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে অথবা ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ¦র নির্ণয় করা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে ৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মাঝে ১০ থেকে ২০ হাজারের মতো মারা যায়। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উলেস্নখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎস ও সংক্রমণ সম্পর্কে বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগের একটি হিসাবে ডেঙ্গুকে চিহ্নিত করেছে।
সাধারণভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন অথবা সাধারণ জ¦রের মতো সামান্য উপসর্গযুক্ত। বাকিদের রোগ হয় আরো জটিল এবং স্বল্প অনুপাতে এটি প্রাণঘাতীও হয়। উপসর্গসমূহের সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময় স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন। অতএব, আক্রান্ত এলাকাফেরত পর্যটকদের ডেঙ্গু হয়নি বোঝা যাবে যদি ঘরে ফেরার ১৪ দিন পরে জ¦র ও অন্যান্য উপসর্গ শুরু না হয়। বাচ্চাদের প্রায়ই এই উপসর্গগুলো হয়, যেমন- সাধারণ সর্দি, বমি ও ডায়েরিয়া আর বড়দের চেয়ে উপসর্গের তীব্রতা কম হয় ছোটদের কিন্তু রোগের জটিলতার শিকার শিশুরা বেশি পরিমাণে হয়।
ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো হলো হঠাৎ জ¦র হওয়া, মাথাব্যথা, মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, এবং যাশ বেরোনো। ডেঙ্গুর আরেক নাম "হাড়-ভাঙা জ¦র" যা এই মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা থেকে এসেছে। মেরুদন্ড ও কোমরে ব্যথা হওয়া এ রোগের বিশেষ লক্ষণ। সংক্রমণের কোর্স তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত: প্রাথমিক, প্রবল এবং আরোগ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অত্যধিক জ¦র, সঙ্গে থাকে সাধারণ ব্যথা ও মাথাব্যথা। এটি সাধারণত দুই থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে ৫০-৮০ ভাগ উপসর্র্গে যাশ বেরোয়। উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়, অথবা পরে অসুখের মধ্যে হামের মতোর্ যাশ দেখা দেয়।
কিছু ছোট লাল বিন্দু যেগুলো ত্বকে চাপ দিলে অদৃশ্য হয় না এবং যেগুলোর আবির্ভাব হয় ত্বকে চাপ দিলে যার কারণ হচ্ছে ভগ্ন রক্তবাহী নালি, এই জায়গায় আবির্ভূত হতে পারে এবং কারও আবার মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে। কিছু লোকের ক্ষেত্রে অসুখটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার কারণে প্রবল জ¦র হয় এবং সাধারণত এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। এই পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে তরল বুক এবং অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে বর্ধিত ক্যাপিলারি শোষণ ও লিকেজের কারণে জমে। এর ফলে রক্তপ্রবাহে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়। এই পর্যায়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকলতা এবং প্রবল রক্তপাত হয়। ডেঙ্গুর ৫ ভাগেরও কম ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ঘটে, তবে যাদের আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্যান্য স্টিরিওটাইপের সংক্রমণ বা সেকেন্ডারি ইনফেকশন ঘটেছে তারা বর্ধিত বিপদের মধ্যে রয়েছেন। ডেঙ্গু ফিভার ভাইরাস ঋষধারারৎঁং জিনের ঋষধারারৎরফধব পরিবারের একটি আরএনএ ভাইরাস। একই জিনের অন্য সদস্যদের মধ্যে আছে ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, সেন্ট লুইস এনকেফেলাইটিস ভাইরাস, জাপানি এনকেফেলাইটিস ভাইরাস, টিক-বর্ন এনকেফেলাইটিস ভাইরাস, ক্যাজেনুর ফরেস্ট ডিজিজ ভাইরাস এবং ওমস্ক হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস- যাদের বেশির ভাগই আর্থ্রোপড বা পতঙ্গ পরিবাহিত আর তাই এদের বলা হয় আর্বোভাইরাস। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রাথমিকভাবে এডিস মশা দ্বারা পরিবাহিত হয়, বিশেষ করে অ. ধবমুঢ়ঃর। এরা মূলত দিনের বেলা কামড়ায়। অন্যান্য "এডিস" প্রজাতির মশা যারা রোগ ছড়ায় তাদের মধ্যে আছে albopictus, A. polynesiensis Ges A. scutellaris.
এই ভাইরাসের প্রাথমিক ধারক মানুষ, কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্য প্রাইমেটদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। একবারের কামড়েই সংক্রমণ হতে পারে। স্ত্রী মশা ডেঙ্গু আক্রান্তের রক্তপান করে নিজে সংক্রমিত হয় ও পেটে ভাইরাস বহন করে। প্রায় ৮-১০ দিন পর ভাইরাস মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে- যার মধ্যে আছে মশার লালাগ্রন্থি এবং শেষে এর লালায় চলে আসে। সারা জীবনের জন্য আক্রান্ত হলেও মশার ওপর এই ভাইরাসের কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে না। 'এডিস ইজিপ্টি' কৃত্রিম জলাধারে ডিম পাড়তে, মানুষের সব চেয়ে কাছে থাকতে এবং অন্যান্য মেরুদন্ডীদের চাইতে মানুষের রক্ত খেতে বেশি পছন্দ করে।
শিশু ও ছোট বাচ্চাদের মধ্যে রোগের প্রাবল্য বেশি দেখা যায়। এতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বিপদ বেশি। যাদের ক্রনিক অসুখ আছে, যেমন- ডায়াবেটিস ও অ্যাজমা, তাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হতে পারে। যখন ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা কাউকে কামড়ায় তখন মশার লালার মাধ্যমে ভাইরাস ত্বকের ভেতর প্রবেশ করে। এটি বাসস্থান পাকা করে নেয় এবং শ্বেত রক্তকোষে প্রবেশ করে এবং যখন কোষগুলো শরীরের সর্বত্র চলাচল করে তখন সেগুলোর ভেতরে এই ভাইরাস প্রজনন কার্য চালিয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় শ্বেত রক্তকোষগুলো বহুসংখ্যক সিগন্যালিং প্রোটিন তৈরি করে যেমন ইন্টারফেরন- যা অনেকগুলো উপসর্গের জন্য দায়ী, যেমন- জ¦র, ফ্লু এবং প্রচন্ড যন্ত্রণা।
প্রবল সংক্রমণে শরীরের ভেতরে ভাইরাসের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, অনেক বেশি প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং রক্ত¯্রােত থেকে তরল ক্ষুদ্র রক্তনালির দেওয়াল থেকে শরীরগহ্বরে চুঁইয়ে পড়ে। ফলে, রক্তনালিতে কম রক্ত সংবহিত হয় এবং রক্তচাপ এত বেশি কমে যায় যে, প্রয়োজনীয় অঙ্গসমূহে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত সরবরাহ হতে পারে না। উপরন্তু অস্থিমজ্জা কাজ না করায় অনুচক্রিকা বা পেস্নটলেটসের সংখ্যাও কমে যায়- যা কার্যকরী রক্ততঞ্চনের জন্য দরকারি। এতে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়- যা ডেঙ্গু জ¦রের অন্যতম বড় সমস্যা।
ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো স্বীকৃত টিকা বা ভ্যাকসিন নেই। সুতরাং প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার কামড় থেকে সুরক্ষার ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচটি মৌলিক নির্দেশনাসমেত সংবদ্ধ একমুখী নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সুপারিশ করেছে: (১) প্রচার, সামাজিক সক্রিয়তা, জনস্বাস্থ্য সংগঠন ও সম্প্রদায়সমূহকে শক্তিশালী করতে আইন প্রণয়ন (২) সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিভাগসমূহের মধ্যে সহযোগিতা (৩) সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার করে রোগ নিয়ন্ত্রণে সুসংবদ্ধ প্রয়াস (৪) যে কোনো হস্তক্ষেপ যাতে সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে হয় তা সুনিশ্চিত করতে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং (৫) স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত সাড়া পেতে সক্ষমতা বৃদ্ধি।
A. aegypti-কে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাথমিক পদ্ধতি হলো এর বৃদ্ধির পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা। পানির পাত্র খালি করে অথবা কীটনাশক প্রয়োগ করে অথবা এসব জায়গায় বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল এজেন্ট প্রয়োগ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদিও অর্গ্যানোফসফেট বা পাইরেথ্রয়েড স্প্রে করাকে খুব লাভজনক ভাবা হয় না। স্বাস্থ্যের ওপর কীটনাশকের কুপ্রভাব এবং কন্ট্রোল এজেন্টের ব্যয়বহুলতার কথা মাথায় রেখে পরিবেশ শোধনের মাধ্যমে জমা পানি কম করাটাই নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভালো উপায়। মানুষ পুরো শরীর ঢাকা পোশাক পরে, বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করে বা কীট প্রতিরোধক রাসায়নিক প্রয়োগ করে মশার কামড় এড়াতে পারে। ১৯৬০ থেকে ২০২০-এর মধ্যে ডেঙ্গুর ঘটনা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মনে করা হয় শহরীকরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক যাত্রার বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মহামারিপ্রবণ এলাকাগুলোতে গ্রাম, শহর ও নগরের সম্প্রসারণ এবং মানুষের বর্ধিত চলাচল মহামারির বৃদ্ধি ও ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী।
মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্র্রতিরোধ করতে হবে।
এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন পাত্র, যেমন- কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোসা, গর্ত, ছাঁদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। ডেঙ্গু জ¦র হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। জ¦র কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে। প্রায়শ রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে এবং মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু হলে কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক ও নন- স্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আরাফাত রহমান : কলাম লেখক