নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম রবি (৫২) জ¦র, ঠান্ডা-কাশি তথা করোনাভাইরাসে ভুগছিলেন। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে স্বজনেরা তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নড়াইল সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র ভেন্টিলেটরের অভাবে তার মৃত্যু হয়। শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের চিকিৎসায় এ হাসপাতালটিতে চারটি ভেন্টিলেটর রয়েছে। দু’টি পৌঁছেছে সাত মাস আগে। বাকি দু’টি পৌঁছেছে পাঁচ মাস আগে। অথচ এখন পর্যন্ত ভেন্টিলেটরগুলো বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। এদিকে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে এই হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীদের ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিলে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধার সৃষ্টি হয়। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন হয় ভেন্টিলেটর সাপোর্টের। বিশেষ করে জটিল করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে করোনার বিরুদ্ধে লড়তে ভেন্টিলেটরের কোনো বিকল্প নেই। অথচ ভেন্টিলেটর পড়ে আছে হাসপাতালে মেঝেতে। দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলো পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ভেন্টিলেটর পরিচালনার জন্য দক্ষ চিকিৎসক দরকার। ভেন্টিলেটরগুলো জেলায় জেলায় দিলে হবে না। কারণ ভেন্টিলেটর দিলে পুরো ইউনিট তৈরি করতে হয়। ইউনিট তৈরি করার মতো এত জনবলও নাই।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৩ ডিসেম্বর এই হাসপাতালে স্থাপনের জন্য দু’টি ভেন্টিলেটর যন্ত্র পাঠায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেয়া হয় আরও দুটি ভেন্টিলেটর। এ দুটি রাখা হয়েছে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় অফিস কক্ষের বারান্দায়, অন্য দুুটি একতলা ভবনের করোনা ওয়ার্ডের মধ্যে। হাসপাতালে সম্প্রতি চালু হয়েছে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা।
নড়াইল জেলায় টানা ২৫ দিন সর্বাত্মক বিধিনিষেধের পরও করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। জুনের মাঝামাঝি সময়ে জেলায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এ সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ দিনই সংক্রমণ ৩০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত ২৯ জুন এটি সর্বোচ্চ ৮২ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত এক মাসেই ৪৪ জন মারা গেছেন। জুনের শেষ ১৫ দিনে মারা গেছেন ১৬ জন। আর জুলাইয়ের ১৬ দিনে ৩১ জন মারা গেছেন।
বাক্সবন্দী ভেন্টিলেটরগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আসাদুজ্জামান টনি জানান, ‘আইসিইউ শুরু না করলে ভেন্টিলেটরগুলো দরকার হচ্ছে না।’ তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দু’জন আইসিইউ বিশেষজ্ঞ জানান, ‘আইসিইউ ছাড়াও ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা যায়। এটি সদ্বিচ্ছার ব্যাপার। এটি দিয়ে যাত্রা শুরু করে ধাপে ধাপে আইসিইউ করা যায়। সিএমএসডিতে অসংখ্য অটোমেটেড (আইসিইউ) শয্যা আছে, তা চাইলেই পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন নাছিমা আকতার বলেন, ‘জেলা সদর হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি হচ্ছে। তাই আমরা দু’টি ভেন্টিলেটর সেখানে দিয়েছি। এখন চালু করার দায়িত্ব তত্ত্বাবধায়কের।’
হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স (ইনচার্জ) বাসনা সাহা জানান, ‘দুটি ভেন্টিলেটর দুই/আড়াই মাস আগে করোনা ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে, তা আজ অবধি বাক্সবন্দী। তিনি আরো বলেন, ‘এটি চালানোর নিয়ম শেখাতে তিনদিন ঢাকা থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমাকে। আমি প্রশিক্ষণের সময়েই বলেছি ,আমি কিছু বুজতে পারিনি। তখন প্রতিউত্তরে সেখান থেকে বলা হয়েছে তাঁরা এগুলো এখানে এসে চালিয়ে দিয়ে যাবেন।’
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এ এফ এম মশিউর রহমানের বলেন, ‘হাসপাতালে ভেন্টিলেটর যেটা ইন্সটলেশন হয় নাই, সেটাতো আমরা কিছু করতে পারতেছি না। বাক্সের ভেতরে যে কি আছে এটাও তো খুলে আমরা দেখতে পারতেছি না, যতক্ষণ তাঁরা (সিএমএসডি) না আসে চালু করে দেবে। আমরা তাঁদের লিখছি। এইগুলা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ভেন্টিলেটর দিলেই তো আর হবে না, তা যে চালাবে তাঁরতো ট্রেনিং দিতে হবে। সেটাতো করে নাই।’
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে উপ-পরিচালক (পিঅ্যান্ডসি) মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমর বার্তা (ম্যাসেজ) পেলেই ভেন্টিলেটর চালু করার ব্যবস্থা করে দেই। চালু হয়নি এটা ফোনে জানালেও আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’