বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মুহূর্তে আমাদের অঙ্গীকার হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণ। এ কাজে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার আমাদের আশার আলো দেখাতে পারে বলেই আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত রাজনৈতিক-দর্শন 'শোষিতের গণতন্ত্রে' উদ্বুদ্ধ হয়েই আমাদের সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
হাজার বছরের শোষণ-দুঃশাসনের শৃঙ্খল ছিন্ন করে বাঙালি জাতিকে যেই মহান নেতা ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দেন তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবন ছিল তার। এই পঞ্চান্ন বছরের জীবনে আটাশ বছর তিনি লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। কারাভ্যন্তরে কাটিয়েছেন এক যুগেরও বেশি সময়। জেল-জুলুম-নির্যাতন ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার মতো অগ্রগামী নেতা বাংলার ইতিহাসে বিরল। যাদের হাত ধরে বঙ্গবন্ধু নেতারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই নেতৃত্বের যোগ্যতায় বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিলেন না, কিন্তু পূর্ববর্তী বাঙালি নেতারা প্রত্যেকেই কমবেশি আপসকামী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র আপসহীন মনোভাব ও অটল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুর্জয় সাহসে এগিয়ে গেছেন। এজন্যই তিনি একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার লাল সূর্য উপহার দিতে পেরেছেন, নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশও শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে তাকে দিয়েছে জাতির পিতা উপাধি। শেখ মুজিব আজ শুধু বঙ্গবন্ধু পরিচয়েই সীমাবদ্ধ নন, তিনি এখন 'বিশ্ববন্ধু' উপাধিতে ভূষিত। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার নামে সড়ক-মহাসড়কের নামকরণ করা হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে 'চেয়ার' স্থাপন করা হচ্ছে, ইউনেস্কোর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তার নামে পদক প্রচলন করতে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই তিনি উদ্ভাসিত হচ্ছেন। যে ঘাতকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই তার নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন করা যাবে- তারাই বরং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঠিকই সূর্যের মতো জ¦লে উঠছেন প্রতিদিন। সূর্যকে যেমন হাত দিয়ে আড়াল করা যায় না, বঙ্গবন্ধুকেও কেউ বিস্মৃতির অতলে আড়াল করতে পারবে না। সমগ্র বিশ্বে এখন বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় ভাস্বর।
কিছুদিন ধরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা বইগুলোর অডিও সংস্করণ শুনছি। এগুলো শুনতে শুনতে আমি যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমার সেই সোনালি যৌবনের দিনগুলোতে। বঙ্গবন্ধু তার লেখায় যেসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন রাজনৈতিক সূত্রেই সেগুলোর সঙ্গে আমি কমবেশি পরিচিত। এসব পরিচিত ঘটনাবলির ভেতর দিয়ে আমি যেন বারবার গৌরবোজ্জ্বল অতীতকেই আলিঙ্গন করছিলাম।
আমি ও আমার সহযোদ্ধা, যারা প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা একটি শোষণহীন দেশ গড়ার অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিলাম। সে সময়ে আমাদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাকর্মীই ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা করেননি। দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল সাধনই ছিল আমাদের একমাত্র ব্রত। আজ আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও পরোক্ষভাবে রাজনীতিই আমার ধ্যানজ্ঞান। পরোক্ষ রাজনীতির বাইরে আমি আর যা কিছু করি তাহলো লেখাপড়া ও গবেষণা। এ পর্যন্ত আমার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। এই শতাধিক গ্রন্থের অধিকাংশই হলো বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত। ভাবতে ভালো লাগছে, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক অনেক মূল্যবান গ্রন্থই আমার হাতে জন্ম নিয়েছে। ২০০৮ সালে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি' শীর্ষক গ্রন্থ দুই খন্ডে প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পাঠকের ঘরে এই গ্রন্থ সমাদরে শোভা পাচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের খবর একজন লেখক-সম্পাদকের কাছে আর কী হতে পারে? এমনকি বঙ্গবন্ধুর পান্ডুলিপি থেকে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' শিরোনামে যে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর সুমহান বদান্যতায় সে গ্রন্থের সঙ্গেও আমি কিছুটা যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ একটি উচ্চমানের সম্পাদনা-পর্ষদ গঠন করে যেসব বইপত্র প্রকাশ করেছে সেগুলোও সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আজকের অনুকূল পরিবেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজ করা যত সহজ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পরে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা এতটা সহজ ছিল না। আজ যখন বাধাহীন পরিবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো শুনি, কিংবা নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখি, তখন এই ভেবে আনন্দ পাই, আমাদের সংগ্রাম বৃথা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যারা জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছি এবং এখনো করছি, তারা যখন দেখি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আবার বঙ্গবন্ধু জেগে উঠেছেন, তখন আবেগে চোখ ভরে ওঠে।
আমি যখন বাংলা একাডেমি থেকে দুই খন্ডে বঙ্গবন্ধুর জীবনী প্রকাশ করি, তখন বেশকিছু দলিলপত্র অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করি। এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা চিঠি, গোয়েন্দা রিপোর্ট উলেস্নখযোগ্য। এই কাজের সূত্র ধরেই 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র সঙ্গে যুক্ত হই। যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত পরামর্শে এ কাজে সম্পৃক্ত হই তা অনেকটা এরকম- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার কাছে দুজন লোকের সন্ধান চান যারা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, আমি তখন শামসুজ্জামান খান ও শামসুল হুদা হারুনের কথা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করি। বর্তমানে এই দুজনই প্রয়াত। দুজনই আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
শামসুল হুদা হারুন 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তার অনুবাদে সজীব ওয়াজেদ জয় ততটা খুশি হননি। এরপরে যুক্ত হন ডক্টর ফখরুল ইসলাম। শামসুজ্জামান খান সহযোগিতা করেছেন বাংলা পান্ডুলিপি সম্পাদনার কাজে। কীভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা পান্ডুলিপি 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'রূপে প্রকাশিত হলো গ্রন্থের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী তা সবিস্তারে উলেস্নখ করেছেন বিধায় আমি আর সেই বিষয়ে পুনরুক্তি করলাম না। এই স্মৃতিবিজড়িত দুষ্পাঠ্য প্রায় পান্ডুলিপি থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার অন্তরঙ্গ বান্ধবী বেবি মওদুদ যেভাবে বইয়ের রূপ দিয়েছেন তা আসলেই বিস্ময়কর। কত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যে বঙ্গবন্ধুর এই মূল্যবান দলিলগুলো মানুষের হাতে বই আকারে পৌঁছেছে তা আসলে রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।
বঙ্গবন্ধু বাইরে যেমন নেতৃত্ব দিতেন, জেলের ভেতরেও তিনি নেতা হয়ে উঠেছিলেন। জেলবন্দি সব মানুষই তাকে ভালোবাসতেন, এমনকি জেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাকে সমীহ করতেন, শ্রদ্ধার সঙ্গে আচরণ করতেন। জেলে বসেই বঙ্গবন্ধু তার জীবন কাহিনি লিখতে শুরু করেন। লেখা কিছুটা অগ্রসর হলে এগুলো শেখ ফজলুল হক মণির হস্তগত হয়। শেখ মণি এগুলো কম্পোজ করার জন্য তার 'বাংলার বাণী'র অফিসে রেখে দেন। খাতাগুলো তার ড্রয়ারে পড়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে দীর্ঘদিন এসব হাতে লেখা পান্ডুলিপির হদিস পাওয়া যায়নি। পরে শেখ সেলিমের হাত ঘুরে এই মূল্যবান খাতাগুলো জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছালে, তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলার মানুষের হাতে জাতির জনকের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থরূপে তুলে দেন। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবনীই নয়, এটা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল। এই দলিল প্রকাশ হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু আজ অনন্য হয়ে ধরা দিয়েছেন বাঙালির অন্তরে। বঙ্গবন্ধুর বইগুলোর অডিও সংস্করণ শুনতে শুনতে এসব কথাই বারবার মনে পড়ছিল।
বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি মূল্যবান গ্রন্থের দ্বিতীয়টি হলো 'কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)'। এই বইটির বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। 'কারাগারের রোজনামচা' শুনছিলাম আর বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা শুনে আপস্নুত হচ্ছিলাম। জেলে থেকে বঙ্গবন্ধু অনেক বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হাসি-কান্না, বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। তার উপলব্ধি, তার সংগ্রামী মনোভাব জেলের প্রাণহীন পরিবেশে বিভ্রান্ত না হয়ে সেগুলো কীভাবে আরও শক্তি সঞ্চয় করেছে, বঙ্গবন্ধু তা অকপটে অঙ্কন করে গেছেন। কারাগার বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বাসভবন ছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কারাগারেই অতিবাহিত হয়। এক যুগের অধিককাল তিনি কারাবাস করেন।
পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে ভীষণ ভয় পেতেন। তারা মনে করতেন বঙ্গবন্ধুকে জেলে রাখাই নিরাপদ। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর গোলাম মোহাম্মদকে লেখা একটি গোপন চিঠিতে ইস্কান্দার মির্জা যা লিখেছেন তা উদ্ধৃত করলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। এই চিঠিতে যুক্তফ্রন্টের যেসব নেতার সম্পর্কে উলেস্নখ আছে- তারা হলেন এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ইস্কান্দার মির্জা লেখেন- Sheikh Mujibur Rahman has been in prison several :iems, Is a remarkbly good organiæer. Have guts. Holds extreme views in politics. Is an experienced agitator. May be described as :he stormy petrel of :he Awami League. A dangerous gentlemen who is best in jail. . [সূত্র : মোনায়েম সরকার সম্পাদিত : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি, পৃ. ৯৪৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৮]
তাই পাকিস্তানি নির্মম শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে জেলে রেখেই বাঙালিদের শাসন করার অপচেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু জেলে বই পড়তেন, জেলবন্দি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারতেন, এমনকি জেলে বসে ঠান্ডা মাথায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডও পরিচালনা করতেন। ত্যাগের শিক্ষা না পেয়ে শুধু ভোগের পথে হাঁটলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জীবনকে উপলব্ধি করতে পারেন না। ত্যাগের মানসিকতা তখনই তৈরি হয় যখন কর্মীরা জেল-জুলুম, অত্যাচারের মুখোমুখি হয়। বঙ্গবন্ধু এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন বলেই জেল-জুলুমকে তিনি কখনো ভয় পাননি। তিনি 'কারাগারের রোজনামচায়' লিখেছেন- জেলখাটা ও কষ্ট করা শিখতে দাও, এতে কর্মীদের মধ্যে ত্যাগের প্রেরণা জাগবে। ত্যাগই তো দরকার। ত্যাগের ভিতর দিয়েই জনগণের মুক্তি আসবে।
আজকের দিনে রাজনৈতিক কর্মীদের ভোগবাদী ও দুর্বৃত্তপনা মানসিকতা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। হাতে গোনা দুই-একজন বাদে বেশির ভাগ নেতাকর্মীই এখন নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এসব নেতাকর্মীর জন্যই দেশের ও দেশের মানুষের এত দুর্ভোগ। রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্থ করার জন্য 'কারাগারের রোজনামচা' থেকে আমাদের সবার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় গ্রন্থ 'আমার দেখা নয়াচীন'। এটি ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশ মুহূর্ত থেকেই বইটি সুধী সমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর চীন ভ্রমণের কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। চীন সফরকালে চীনে বঙ্গবন্ধু কী কী করেছেন এবং কী কী দেখেছেন তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন। বিপস্নবোত্তর রাষ্ট্র কীভাবে গড়ে তুলতে হয় সেই শিক্ষা বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়ে পেয়েছিলেন। চীন ভ্রমণ বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ' গঠন করেন তখন তার মনে হয়তো চীন সফরের অভিজ্ঞতাও উঁকি দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু যখন তার নেতৃত্বের মধ্যগগনে বিরাজমান তখন বিশ্বে 'কোল্ডওয়্যার পিরিয়ড' চলছে, সারা দুনিয়ায়ই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এ রকম একটি বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সেদিন। চীনের অভিজ্ঞতা, রাশিয়া ভ্রমণের স্মৃতি, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ সর্বোপরি রুশ বিপস্নব, মার্কসবাদ, লেনিনবাদের অমিয়বাণী বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে নাড়া দিলেও তিনি সরাসরি সমাজতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হতে চাননি। বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেই অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন, ছাত্রজীবন থেকেই তার মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে চলার উৎসাহ দেখা যায়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি নতুন এক মতবাদের জন্ম দেন, যে মতবাদ পরে 'শোষিতের গণতন্ত্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সমাজ-বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন জীবনধারা মূলত দুই কারণে পরিবর্তিত হয়- একটি হলো বাস্তবিক বা সামাজিক কারণ, অন্যটি হলো জ্ঞানজগৎ বা ভাবজগতের উন্নতি সাধন। আমরা যদি মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে জ্ঞানভিত্তিক জীবন সাধনায় আত্মনিয়োগ করি, তাহলে সেই পরিবর্তন ব্যক্তি, সমাজ, দেশ তথা পৃথিবীর জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম। এক দশক আগেও তথ্যপ্রযুক্তির এত জাদুকরী ক্ষমতা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানবিক গুণাবলির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ইন্টারনেটে যেহেতু মুহূর্তের মধ্যেই প্রত্যাশিত অনেক কিছু পাওয়া যায়, তাই এর ব্যবহার সম্পর্কেও আমাদের সচেতন হতে হবে।
সহজলভ্যতার গুণ যেমন আছে, তেমনি দোষও কম নেই। আমরা ক্ষতিকর বিষয়গুলো পরিহার করে যদি উপকারী বিষয়গুলো গ্রহণ করতে পারি, তাহলেই আমরা লাভবান হবো। এই কথাটা নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের বুঝতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ফলে এখন এক ক্লিকেই ই-বুক, অডিও বুক, চ্যাটিং, সভা-সেমিনারসহ পঠন-শ্রবণ সহজতর হয়েছে। যেসব লেখক-সাহিত্যিক-দার্শনিক-সমাজচিন্তকদের গ্রন্থরাজি দুষ্প্রাপ্য ছিল, তাও এখন অনায়াসে পাঠযোগ্য। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মুহূর্তে আমাদের অঙ্গীকার হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণ। এ কাজে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার আমাদের আশার আলো দেখাতে পারে বলেই আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত রাজনৈতিক-দর্শন 'শোষিতের গণতন্ত্রে' উদ্বুদ্ধ হয়েই আমাদের সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ