একটা সময় ছিলো তাস, ডাংগুলি কিংবা অন্য যে কোনভাবে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে জুয়া খেলার প্রচলন। বর্তমান ডিজিটাল যুগে সেইসব নিয়মগুলোকে পাস কাটিয়ে বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন জুয়ার আসর। এর এই অনলাইন জমজমাট জুয়ার আসর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার মহামারিতে দীর্ঘদিন স্কুল স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এই জুয়ার অংশগ্রহণ করছে শিক্ষার্থীরা। আর এসব জুয়া খেলায় বাজি লেগে নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। ডিজিটাল যুগে যে কোন সময়ে এই খেলায় অংশগ্রহণ করা যাচ্ছে। ফলে পিত-মাতাও জানতে পারছে না নিজ সন্তানেরা কখন এসব কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে। বাজিতে বিভিন্ন অংকের টাকা, মোবাইল, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস একে অপরের কাছে হেরে যাওয়ায় নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। তবে সমাজে চক্ষু লজ্জার কারণে এসব ঘটনা অনেকটাই ধামাচাপা থেকে যাচ্ছে আর একেক পরিবার নিরবেই তা সহ্য করে দিন পার করছে।
শুধু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাই নয় গোদাগাড়ী উপজেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা অনলাইন জুয়ার আসরে ঝুঁকে পড়েছে। জুয়া খেলার একটি বেদেশী অ্যাপস এর মাধ্যমে ডলার কিনে গোদাগাড়ীর বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন এলাকার উঠতি বয়সি ছেলেদের এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ প্রদান করছে।
এই জুয়া খেলার বিভিন্ন নিয়ম কলাকৌশল ও নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে অনুসন্ধানে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলার জন্য ইংল্যান্ডের একটি অ্যাপস যার নাম ইবঃ৩৬৫ (বেট৩৬৫) তা ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও জুয়া খেলার দেশী অ্যাপস ৯ঊীপযধহম (নাইন এক্সচেঞ্জ) ব্যবহার করে খেলা চলছে হরদম। খেলায় অংশগ্রহণ করে হার জিতে যত টাকার বাজি ধরা হয় তার দ্বিগুণ হতে ৫ গুণ টাকা লাভ ক্ষতি হয়। যার জিতে যায় তারা আরো বেশী পরিমাণ জুয়ার নেশায় মেতে উঠে আর যারা হেরে যায় তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে খেলা চালিয়ে থাকে। এই অ্যাপসটি বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই খেলায় বিদেশীরা বাংলাদেশী এজেন্ট ঠিক করে রেখেছে। বাংলাদেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এদের বেশ কয়েকজন মূল নিয়ন্ত্রক আছে। এরা আবার দেশের বিভিন্ন জেলায়এজেন্ট ঠিক করে বেট৩৬৫ নামক অ্যপস দিয়ে জুয়া খেলার অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছে। এরা আবার পুনরায় উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে এজেন্ট ঠিক করে খেলা পরিচালনা করে আসছে। এই অ্যাপস এর একাউন্টে লক্ষ লক্ষ ডলার জমা থাকে বলে জানা গেছে। এভাবে অনলাইনে জুয়ার খেলার কারণে নিরবেই কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
রাজশাহী জেলায় অনলাইন জুয়ার মূল হোতা যিনি আছে তার নাম রুবেল। সে রাজশাহী কোর্ট স্টেশন বাজারের একটি মার্কেটের দ্বোতলা অফিস হতে পরিচালনা করে আসছে।
গোদাগাড়ী উপজেলায় এই রুবেলরই এজেন্ট রয়েছে বেশ কিছু মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। গোদাগাড়ী পৌর সদরে অনলাইনে জুয়ার মূল হোতা হলো মাদারপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে নাইমুল ইসলাম (৩০)। সে চার বছর আগে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে সে এই জুয়ার কারবার করে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালিক বলে জানা গেছে। এছাড়াও তৈরী করেছে বিলাশ বহুল বাড়ী। সে আবার তার অধিনস্থ বেশ কয়েক জনকে এই খেলায় এজেন্ট হিসেবে রেখেছে। এরা হলো মাদারপুরের সাইদুর রহমানের ছেলে আল-আমিন (২৫)। সে মাদারপুরের ক্লাবপাড়া নিয়ন্ত্রণ করে। বেলাল হোসেনের ছেলে হাসান আলী (২৭)। সে ডিমভাঙ্গা গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইসরাইল হোসেনের ছেলে মতিউর রহমান রুবেল (৩০)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ,এই রুবেল ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ের জুয়ারী। তার অনলাইন আ্যাপস এসব সময়ে ১০-১৫ হাজার ডলার রিজার্ভ থাকে। এলাকর ছোট বড় জুয়ারীদের বিকাশের মাধ্যমে ঢাকা পরিশোধ করে থাকে। রুবেল মাদারপুর গ্রামে বিকাশ ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের কাছে বাকিতে টাকা পরিশোধ করতো। গত ২৭ জুলাই রাতে বিকাশ ব্যবসায়ী বাকি টাকা চাইতে গেলে তাকে পরিকল্পিত ভাবে মাথার বিভিন্ন অংশে, ঘাড়ে, হাতে ও পায়ে চাপাতি মেরে প্রাণ নাশের চেষ্ঠা করে। ওই বিকাশ ব্যবসায়ীর হাতে ও পায়ের রগ কেটে যাওয়ায় একখ পঙ্গুত্ব হয়ে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
প্রায় ৭-৮ বছর হতে শুধু মাত্র এই অনলাইন জুয়ার কারবার করে সে অঢেল সম্পর্তির মালিক হয়ে গেছে। সে সেভেন আপ কোম্পানীর ডিলার নিয়ে ব্যবসা করছে। এছাড়াও আলিশান বাড়ী তৈরী করে বাড়ীতে এসি লাগানো থেকে শুরু করে সকল বিলাসিতা ভোগ করছে। এছাড়াও সে বেশ কিছু পুকুর চাষ করছে বলে জানা গেছে।
এই খেলায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ৫০০-৫০০০ টাকা বাজি ধরছে। আবার শীর্ষ মাদকব্যবসায়ীরা ২ লাখ হতে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাজি ধরে খেলায় অংশগ্রহণ করছে।
ক্রিকেট খেলায় বল, ওভার, খেলোয়ার ও ম্যাচ ভিত্তিক বাজি লাগিয়ে যারা জুয়া পরিচালনা করছেন তারা হলো, মাদারপুর গ্রামের নওশাদ জামাতির ছেলে মাদক স¤্রাট আলমগীর (৪২)। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর হতে গভীর রাত পর্যন্ত মাদারপুরের ফরহাদের দোকানে বসে মোবাইলে জুয়া খেলার বাজিগরদের নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সাথে টাকা উত্তোলনের কাজের জন্য তার সাথে যোগাযোগ করে। দোকানদার ফরহাদের নিজস্ব ডলারে জুয়া খেলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
একই এলাকার আরেক মাদক স¤্রাট বানুর ছেলে ফরিদুল ইসলাম (২৮)। সে এই এলাকার বড় বাজিদার। স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ভূক্ত মাদক স¤্রাট সদ্য প্রায়াত সেলিমের শ্যালক এবং মাদক ব্যবসায়ী পঁচা মোস্তফার ছেলে মাদক ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম (১৮)। বয়স মাত্র ১৮ হলেও এই বয়সে হয়েছে প্রচুর টাকার মালিক।
একই এলাকার শামসুলের ছেলে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সগর (২২)। এই ২২ বছর বয়সেই গড়ে তুলেছে আলিশান বাড়ী ও বাড়ীতে এসি। তার চলাফেরায় একরকম জমিদারি ভাব ফুটে উঠেছে বলে এলাকার মানুষ জানান। সেও অনলাইন জুয়ার অংশগ্রহণ ও টাকা লেনদেনের সাথে জড়িত রয়েছে।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জুয়ারী হিসেবে এলাকায় এলাকার যুব সমাজকে নষ্টের পথে নিয়ে যাচ্ছে মহিশালবাড়ীর মামুন পান স্টোর, গোগ্রামের রক্তিম (৩০), সেলিম (৩০), সুমন (২৮) ,আলিমগঞ্জের বাপ্পি, রাজাবাড়ীর ডেইরী ফার্ম সোহেল, জনি, তুহিন, বিজয় নগরের যুবদলনেতা টনি, চাপাল এলাকার রুবেল, বিদিরপুরের হামিম,জনি, বিয়নাবোনার রকি, জনি, রাসেল ও রিপন। এই রিপন জুয়া খেলে নি:স্ব হয়ে গেছে। এছাড়াও গোদাগাড়ী উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলে এই খেলা এখন ছড়িয়ে পড়েছে।
গত ২৭ জুলাই গোদাগাড়ী উপজেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা সভায় জুয়া খেলার টাকা নিয়ে চাপানি দিয়ে কোপানোর ঘটনায় সভার সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: জানে আলমসহ সভার সুধিজন চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে।
এই বিষয়ে গোদাগাড়ী মডেল থানার ওসি মো: কামরুল ইসলাম বলেন, যারা উপজেলায় এসব জুয়া খেলার সাথে জড়িত তাদের একটি লিস্ট আমরা তৈরী করেছি। তাদের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও তিনি গোদাগাড়ীর সুধিমানুষের কাছে সহযোগিতা চান।