ব্যবসায়ি মঈন উদ্দিন ঠাকুর শুভ। তিন শিশু সন্তানের জনক শুভ’র বয়স ৪৫ বছর। জন্ম সরাইল সদরের বড়দেওয়ান পাড়ায়। পিতা প্রবাসী ও ব্যবসায়ি জুনায়েদ উদ্দিন ঠাকুর (প্রয়াত)। শুভ’র শরীর থেকে মুছে যায়নি তারূণ্য ও টকবগে যুবকের উচ্ছাস। পিতার মত শুভ ছিলেন মানবসেবক। দরিদ্র অসহায় মানুষদের দান করে স্বস্থ্যি পেতেন। সহজেই মানুষকে ভালবেসে কাছে টানতেন। শুভ’র বন্ধুসুলভ আচরণ ও ব্যবহারে মুগ্ধ ছিল মানুষ। স্ত্রী সন্তানদের প্রতি তার দরদ ছিল আকাশ ছুঁয়া। অনেক স্বপ্ন ছিল শুভ’র। কিন্তু কে জানত মহামারি করোনার থাবায় মূহুর্তের মধ্যে এলোমেলো হয়ে যাবে সবকিছু? ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে সকল স্বপ্ন? এত অল্প সময়ে বিধবার শাড়ি পড়বে তার স্ত্রী। চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যাবে তার তিন অবুঝ শিশু। এমনটি কোন দিন কল্পনাও করেননি শুভ। কিন্তু হয়েছে তো তাই। করোনা কেড়ে নিয়েছে শুভ ও তার পরিবারের সকল স্বপ্ন। দীর্ঘ ১৩ দিন করোনার সাথে লড়াই করে অবশেষে গত শনিবার গভীর রাতে পরাজিত হয়েছেন শুভ। আলো নিভে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে শুভ’র পরিবারে। প্রতি মূহুর্তে মূর্ছা যাচ্ছে শুভ’র মা। বাকরূদ্ধ স্ত্রী। শিশু সন্তান বলছে ‘বাবা ঘুমিয়ে আছেন।’ আর গ্রামজুড়ে চলছে কান্না রোল। সরজমিনে ও পারিবারিক সূত্র জানায়, জুনায়েদ উদ্দিন ঠাকুরের ছেলে শুভ। কর্ম ও ব্যবহারে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন সর্বত্রই। মা স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতেন ঢাকায়। গ্রামের প্রতি তার দরদ ছিল। তাই কারণে অকারণে ছুটে আসতেন গ্রামে। মানুষকে দান হয়রাতও করতেন শুভ। তার রয়েছে ৩ শিশু সন্তান। এরা হলো-রিমাজ জুনায়েদ ঠাকুর (১১), রূদোয়া জুনায়েদ ঠাকুর (০৫) ও রাওয়াদ জুনায়েদ ঠাকুর (০৪)। গত ১৩-১৪ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হন শুভ। আক্রান্তের পর ক্রমেই দূর্বল হতে থাকেন। ভয় পেয়ে যান শুভ। ভর্তি হন ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। চলে চিকিৎসা সেবা। ভাল যাচ্ছিল না সময়। একসময় চিকিৎসককে শুভ বলেন আমার ৩টা বাচ্ছা আছে। শান্তনা দিয়েছিলেন চিকিৎসক। শুভ নিজেই অসহায় হয়ে পড়েন। প্রথমে আইসিও। পরে লাইফ সাপোর্ট। দীর্ঘ ১৩ দিন করোনার সাথে লড়াই করেছেন। অবশেষে গত ৭ আগস্ট শনিবার দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শুভ। চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যায় শুভ’র আদরের ৩ অবুঝ শিশু। বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েন স্ত্রী তোনাজ্জিনা ফাতেমা (৩৪)। ফেল ফেল করে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান হারাচ্ছেন শুভ’র মা বিলকিছ মুজিব চৌধুরী (৬৮)। অবিশ্বাস্য খবরে স্তদ্ধ হয়ে পড়েন সকল আত্মীয়স্বজন ও সহপাঠিরা। তাদেরকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই কারো। শুভ’র মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা বড়দেওয়ান পাড়া গ্রামে। আকস্বিক এ মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছিলেন না কেউ। অশ্রƒজলে ভাসছিলেন গোটা গ্রামের নারী পুরূষ। করোনায় মৃত্যু হয়েছে এমনটা ভেবে অনেকে দূরে থাকার চিন্তাও করেছেন। কিন্তু শুভ’র ভালবাসা ও মায়ার বাঁধনের কাছে হেরে গেছে করোনা। শুভ’র নিথর দেহটি কখন আসবে? গতকাল রোববার ভোর থেকে এই অপেক্ষায় ছিলেন গ্রামবাসী ও আত্মীয়-স্বজন। বড়দেওয়ানপাড়া গ্রামের কবরস্থানের পাশের সড়কে মানুষের দীর্ঘ লাইন। চলছে অপেক্ষা। তৈরী হচ্ছে কবর। ঘড়ির কাটায় সকাল ১১টা। দূরে লাশবাহী গাড়ির করূন শব্দ। লোকজনের উপস্থিতি আরো বাড়তে থাকে। অঝরে কাঁদছে লোকজন। প্রথমে শুভ’র মা স্ত্রী ও অবুঝ তিন সন্তানকে বহনকারী প্রাইভেটকার। এর ঠিক পেছনেই লাশবাহী গাড়িটি প্রবেশ করছে বড়দেওয়ান পাড়ায়। কি হৃদয় বিধায়ক দূশ্য! করোনায় মৃত্যু হয়েছে এমনটি ভেবে দূরে দাঁড়িয়ে অনেককে সহানুভূতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। জীবিত শুভ’র সুদিনের অনেক সাথীকেই গতকাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সকাল সাড়ে ১১টায় নিজ বাস ভবনের সামনে জানাযা। কয়েক মিনিটের মধ্যে উপস্থিত দেড়/দুই শতাধিক স্বজন। শুভ’র ছোট ভাই সুহৃদের দুই মিনিটের বক্তব্য কাঁদিয়েছে সবাইকে। জানাযা শেষে বেলা ১২টার দিকে শুভ’র লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। শুভ’র তিন শিশু সন্তানের দিকে তাকালে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। শুভ তো কখনো ভাবেনি দুনিয়া বুঝার আগেই এতিম হয়ে যাবে তার কলিজার টুকরা ৩ সন্তান। মরে যাবে তাদের ভালবাসা। আর এ জন্যই তো চিকিৎসকদের শুভ ৩ সন্তানের কথা জানিয়েছিলেন। আল্লাহ শেষ রক্ষা করেননি। শুভ’র তিন শিশু সন্তান বলে, আমাদের বাবা ঘুমিয়ে আছে। আবার আসবে।’ মৃত্যুর সাড়ে ১১ ঘন্টা পর শুভ’র লাশটি গ্রামে আসে। এরপরও অনেককে করোনা সংক্রমনের আতঙ্কে ভুগতে দেখা গেছে। প্রসঙ্গত: করোনায় সরাইলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই বড় হচ্ছে। সরকারি হিসেবে ৮ জন হলে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। তারপরও এ জনপদের মানুষ গুলোর মধ্যে সচেতনার বিন্দু পরিমাণ লেশ নেই। কেউই এখনো মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। ব্যবহার করছেন না মাস্ক। সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মো. নোমান মিয়া বলেন, শুধুমাত্র অসচেতনা ও অসাবধানতার কারনেই সরাইলে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।