আমরা চাই, সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘœ। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। নারীর কর্মক্ষেত্র আরও বেশি নির্বিঘœ করতে হবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে তা পূরণ করতে হলে পুরুষের সঙ্গে নারীকেও এগিয়ে যেতে হবে।বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল। চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এজন্য আমাদের রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা। এই বিশাল জনসংখ্যার অংশ হলো নারী ও পুরুষ। যে দেশগুলো বিশ্বে উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে পেরেছে সেই সব দেশই নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করেছে। নারী ও পুরুষের পাশাপাশি অবদানেই এগিয়ে চলেছে। আমাদের দেশেও সেটাই হচ্ছে। একসময় যে ক্ষেত্রগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ চিন্তা করা যেত না অথবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেত সেই ক্ষেত্রগুলো এখন মুক্ত। ফলে নারীরা স্বাধীনভাবে এসব ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। দেশ যতই এগিয়ে চলেছে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়ন কাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ। আজ প্রতিটি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রবাস, আইসিটি মোটকথা অর্থনীতি প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। যেখানে নারীরা ঘরের কাজ করত এখন সেখানে কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংসার পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে তারা চাকরি না হয় ব্যবসা করছে। গ্রামে প্রায়ই ছোটোখাটো দোকান চালাতে দেখা যায় নারীদের। ঘরে বসে আজ ই-কমার্সের যুগে নারীরা ব্যবসা করছেন। ২০১০ সালে যেখানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ লাখ সেখানে ২০১৬-১৭ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬ লাখ। এই সময়ের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
নারীর কাজের ক্ষেত্র এখন সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় ক্ষেত্র পোশাক শিল্পে একটি বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করছে। শহরে কর্মজীবী নারীর সঙ্গে গ্রামীণ নারীরাও। হাতের কাজ যেমন- নকশিকাঁথা বোনা, বাঁশ ও বেতের কাজ ছাড়াও নানা হস্তশিল্প, হাঁস-মুরগির খামার, গাভী পালন, পাখি ও কবুতরের খামার, কৃষি কাজ ইত্যাদি নানাভাবে সংসারের আর্থিক অবস্থা পুনর্গঠনে সাহায্য করছে এবং কোনো কোনো সংসারে আর্থিক আয়ে নারীই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। কাজের জন্য নারীরা বিদেশে যাচ্ছে। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৫-০৬ এর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের প্রায় ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী, যারা মূলত কৃষিকাজ, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ ইত্যাদি কৃষি সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। সেখানে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের অনেকে দেশে ফিরে আসছে। কিন্তু এরপরও বহু নারী প্রবাসে শত কষ্ট সহ্য করেও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত সময়ে মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। বাংলাদেশের আজ যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এর পেছনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান রয়েছে। 'এ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর।' কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার লাইন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীর মঙ্গলময় সৃষ্টিতে নারীর রয়েছে সমান অবদান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কিন্তু অতীত কাল থেকেই অবহেলিত। অথচ আমরা নারীর ওপর সহিংসতার আগে ভুলেই যাই যে, এরকমই কোনো নারীর দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা তীব্র যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করার কারণেই আজ আমরা এই পৃথিবীতে।
পৃথিবীতে আজ আমার যে অধিকার বলে চিৎকার করি সে অধিকার আদায়ের শুরুটা পৃথিবীর আলো দেখিয়ে একজন নারীই করেছে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নারীর কাজ যে শুধু সন্তান জন্ম দেয়া- তা বোঝাতেই কেটে গেছে অনেক বছর। নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে আজ মহাশূন্য পর্যন্ত তাদের পদচিহ্ন রাখছে সফলতার সঙ্গে। তবে কাজের ক্ষেত্র বাড়লেও কমেনি নারীর ওপর সহিংসতার হার। বরং দিন দিন সহিংসতার নতুন নতুন ঘৃণ্য রূপ সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। যে সহিংসতা থেকে বাদ পড়ছে না তিন থেকে ত্রিশ বা তদূর্ধ্ব বয়সি নারীরা। তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে, বাসে ট্রামে গণধর্ষণ শেষে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এত সব করেও নারীরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্ধেক শক্তি। নারী শক্তি বাদ দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা অসম্ভব।
নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সীমাবদ্ধ। বাল্যবিয়ে, যৌতুক, ধর্ষণ, রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ,পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে ১১৫৪ জন নারীর যৌতুকের আগুনে জীবন বিনষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ১৯৭ জন, ২০১৩ সালে ২৪৫ জন, ২০১৪ সালে ২৩৬ জন, ২০১৫ সালে ২০৩ জন, ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারীর জীবন যৌতুকের আগুনে ধ্বংস হয়েছে। মূলত বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক নামক এক ভয়ংকর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজও বের হতে পারেনি এ বিশ্ব। কারণ কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত, পাকিস্তানসহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এই বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক প্রথা।
মূলত দয়া নয়, অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই তৈরি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোনো পুরুষ সদস্যের সঙ্গে তুলনায় খাটো করা হয় তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পড়ে। বাসে, অফিসে, রাস্তায় সব সময় যদি নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের নিরাপত্তা পেতে আলাদা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হবে ততদিন পার্থক্য সুস্পষ্ট থেকে যাবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের একবারে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশির ভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেকে মেয়ের ক্ষেত্রেই ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলে সন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী-সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘর কন্যার কাজে লেগে পড়া যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আবার বিয়ের পর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও প্রায়ই দেখা যায়। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা কমছে না।
আমরা চাই, সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘœ। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। নারীর কর্মক্ষেত্র আরও বেশি নির্বিঘœ করতে হবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে তা পূরণ করতে হলে পুরুষের সঙ্গে নারীকেও এগিয়ে যেতে হবে।
অলোক আচার্য : কলাম লেখক