এক হাজার ৩৬৩ দশমিক ৭৬ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট শেরপুর জেলা ৫টি উপজেলা, ৫টি থানা, ৪টি পৌরসভা, ৫২ ইউনিয়ন ও ৬৭৮টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। এ জেলায় ১৪লাখ ৭হাজার ৪৬৮জন লোকের বসবাস। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী বাংলার মানচিত্রে শেরপুরের জন্ম হয়। উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিমে জামালপুর জেলা এবং পুর্ব দিকে ময়মনসিংহ জেলার অবস্থান। জেলায় মোট বনভুমির পরিমান ২ হাজার ৪৯ একর। এরমধ্যে সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরধী উপজেলার পাহাড়ী বনাঞ্চলে বন্যহাতির তান্ডব অব্যাহত রয়েছে। জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদী উপজেলার প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ী অঞ্চলের অন্ততঃ ৫০টি গ্রামে প্রতিদিনই বন্যহাতি তান্ডব চালিয়ে আসছে। ক্ষুধার্ত হাতির দল খাবারের সন্ধানে প্রতিনিয়ত লোকালয়ে আক্রমন চালিয়ে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। এতে দিন দিন সীমান্ত অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামেই হাতি আতংক ছড়িয়ে পড়ছে। সীমান্ত এলাকার মুসলমান, কোচ ও গারো আদিবাসী পরিবারের হাজার হাজার মানুষ বন্যহাতি আতংকে রাত কাটাচ্ছেন। এসব এলাকায় হাতির আক্রমনে নিহত, আহত ও পঙ্গু হচ্ছে মানুষ। অনেকেই ঘর-বাড়ি ফেলে পরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউবা আবার জীবিকার সন্ধানে চলে গেছেন অন্যত্র। এলাকাবাসী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ অঞ্চলের ভুক্তভুগিরা বন্যহাতির অত্যাচার বন্ধে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগি এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানান, দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এসব এলাকায় বন্যহাতি তান্ডব চালিয়ে আসছে। সরকারিভাবে কোন পরিসংখ্যান বা তথ্য পাওয়া না গেলেও বেসরকারি তথ্য মতে, বন্যহাতির নিষ্ঠুর আক্রমনে এযাবকালে প্রায় অর্ধশত লোক অকালে প্রাণ হারিয়েছে। হাতির আক্রমন বন্ধ করতে সরকারিভাবে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহন না করায় শেরপুরের সীমান্ত অঞ্চলের সাধারন মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সরকারিভাবে বন্য হাতির অত্যাচারে নিহত ব্যক্তির কোনো পরিসংখ্যান নেই। হাতির আক্রমনে নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকার অনুদানের ঘোষণা করলেও এ পর্যন্ত অনুদানের টাকা কেউ পাননি।
নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা, পোড়াগাঁও, নয়াবিল ও রামচন্দ্র কুড়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পানিহাটা, মায়াঘাসি, তাড়ানী, নাকুগাঁও, দাওধারা, আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, কোচপাড়া, বুরুঙ্গা, কালাপানি, পোড়াবাড়ি, বাতকুচি, সমেশ্চুড়া, ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ও কাংশা ইউনিয়নের রাংটিয়া, নকশী, দুধনই, সন্ধ্যাকুড়া, গরুচরন, বাকাকুড়া, গজনী, হালচাটি, গান্ধিগাঁও, হলদিগ্রাম, গারোকোনা, শ্রীবরদী উপজেলার রাণীশিমুল ও সিঙ্গাবরুনা ইউনিয়নের জুলগাঁও, বাবলাকোনা, হারিয়াকোনা, চান্দাপাড়া, মেঘাদল, অফিসপাড়া, মালাকোচা, খ্রিস্টানপাড়া, বালিঝুড়ি, রাঙ্গাজান, খারামুড়া ও হালহাটিসহ প্রায় অর্ধশত গ্রামে প্রতিরাতেই কোনো না কোনো গ্রামে প্রায় ৪০-৫০টি বন্যহাতির দল একটানা আক্রমন চালিয়ে আসছে। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবি, দিনমজুর ও শ্রমিক। ক্ষুধার্ত হাতির দল ক্ষেতের ফসল, সবজি বাগান, কলা গাছ ও গাছের কাঁঠাল খাওয়ার জন্য লোকালয়ে আক্রমন চালায়। তাদের তান্ডবে নিঃস্ব হয়েছে অনেকেই।
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শেরপুর-২ আসনের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ প্রয়াত জাহেদ আলী চৌধুরী বন্যহাতির আক্রমন রোধ করতে পাহাড়ী এলাকায় মৌচাষ প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এলাকার সাংসদ ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী হাতি আক্রান্ত এলাকায় বেত বাগান সৃজনের প্রকল্প হাতে নিলেও এসব কোনো প্রকল্পই কাজে আসেনি। জেলা কৃষি বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক প্রয়াত বানেজ আলী মিয়ার সীমান্ত এলাকায় বড়ই গাছ লাগানো প্রকল্প, ‘হাতি-মানুষের সহাবস্থান’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার কোনোটিই কাজে লাগেনি। সাবেক জেলা প্রশাসক মো. নাসিরুজ্জামানের সীমান্তে হাতির অভয়াশ্রম নির্মানের প্রাথমিক প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হলেও সেটিও আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। বরং হাতি আসছে হাতির মতোই। তাদের ধ্বংসলীলা চালাচ্ছেই। যাচাই-বাছাই করা ছাড়াই এসব পরিক্ষামুলক প্রকল্প হাতে নেয়ায় এর কোনোটিই কাজে লাগেনি।
বন্যহাতির আক্রমন থেকে জান-মাল রক্ষা করতে গ্রামবাসীরা রাত জেগে হৈ চৈ করে, মশাল জ্বালিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়িয়ে আসছে। বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতির দল তাড়া খেয়ে তখন ভারত সীমান্ত অংশে আশ্রয় নেয়। তখন ভারতের লোকজন বন্যহাতিকে গুলি করে আবার বাংলাদেশের দিকে তাড়িয়ে দেয়। কোনো সীমানাতেই বন্যহাতি নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে না। একদিকে অশ্রয়স্থল অন্যদিকে পেটের ক্ষুধা তাই দিন দিন বন্যহাতি গুলো হিংস্র হয়ে উঠছে। ভারত অংশে গিয়ে বিএসএফ ও গ্রামের মানুষের বাঁধার মুখে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ হাতি তাড়ানোর জন্য সনাতন পদ্ধতিতে ভোগাবাতি, মশাল আর ডাক-চিৎকার করে। তাছাড়া কেরোসিন তেলের দামও বেশি। এজন্য এ অঞ্চলের অধিবাসীরা ভোগাবাতি আর মশাল জ্বালানোর তেল খরচ বহন করতে পারছেন না। পাশ্ববর্তী রাষ্ট ভারত অংশে আশ্রয় নিতে গেলে সরকারি বেসরকারিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আসলে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনা বলে এলাকাবাসী জানান।
প্রাণ বৈচিত্র রক্ষা চুক্তি অনুযায়ী দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভুমির মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকার কথা থাকলেও তা আমাদের দেশে নেই। যে কারনে হাতি লোকালয়ে চলে আসে। এলাকাবাসী জানান, শেরপুর সীমান্তে বিগত ২০০০ সাল থেকেই বন্যহাতির দল তান্ডব চালাচ্ছে। এ পর্যন্ত কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেও কোনোটিই কার্যকরী হয়নি। আগে এসব পাহাড়ী অঞ্চলে প্রাকৃতিক বনে মধ্যে লতা-গুল্মে ভরপুর ছিল। যা খেয়ে হাতি ক্ষুধা নিবারন করতে পারতো। পরবর্তীকালে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে সরকারি সিদ্ধান্তে পাহাড়ে সামাজিক বনায়ন সৃজন করা হয়।
নালিতাবাড়ীর বাতকুচি বনবিট কর্মকর্তা মির্জা আবুল বাশার বেগ জানান, একটি হাতির প্রতিদিন ১০ মন খাদ্যের প্রয়োজন। কিন্তু এই বন্যহাতিগুলো সে পরিমান খাদ্য এখন আর পায় না। তাই লোকালয়ে হামলা চালাচ্ছে। আন্ধারুপাড়ার ইউপি সদস্য হযরত আলী ইসলাম বলেন, আগের প্রাকৃতিক বন কেটে আকাশমনি, মিনজুরি, ইউকিলিপটাচ ও মেনজিয়াম গাছ লাগানোর ফলে বনের মধ্যে হাতির খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাই ক্ষুধা নিবারনের জন্য বন্যহাতিগুলো পাহাড়ী অঞ্চেলের মানুষের ঘর-বাড়িতে হানা দিয়ে গাছের কাঁঠাল, গোলার ধান, ক্ষেতের ফসল খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে সাবার করে দিচ্ছে।
বনবিভাগ সুত্র জানায়, স্থানীয়ভাবে মতামত বা ক্ষতিকারক দিক বিবেচনা না করে গরীব মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা বিবেচনা করে সরকার সামাজিক বনায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিমধ্যেই ১০ বছর মেয়াদ পুর্ন হওয়ায় এই সামাজিক বনায়নের কিছু কিছু প্লট ইজারা পদ্ধতিতে গাছ বিক্রি করা হয়েছে। এডিপির অর্থায়নে সৃজিত এসব বাগান কর্তনের পর উপকারভোগিরা পাবেন শতকরা ৪৫ ভাগ অর্থ সরকার পাবে শতকরা ৪৫ ভাগ অর্থ আর বাকি শতকরা ১০ ভাগ অর্থ পরবর্তীতে বাগান সৃজনের জন্য ট্রিফার্মিংফান্ড (টিএফএফ) ফান্ডে জমা থাকবে। আকাশমনি, মেনজিয়ম, ইউকিলিপটাচ এসব বিদেশী গাছ সামাজিক বনায়নের গাছ পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় সরকার চলমান সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে দীর্ঘ মেয়াদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মেয়াদকাল হবে ২০ থেকে ২৫ বছর। সামাজিক বগান সৃজনের জন্য মিশ্রবাগান করা হবে। এতে বনজ, ফলদ ও ওষুধী গাছ বিশেষ করে তুন, চিকরাশি, গর্জন, চাপালিশ, অর্জুন, আমলকি, হরতকি, বহেরা, মেহগিনি, লোহাকাঠ, ডেওয়া, গামার, কাঁঠাল, জাম গাছের নার্সারী সাজানো হয়েছে। আগের বাগান কর্তনের পরই এইসব চারা দিয়ে সমাজিক বনায়নের মিশ্রবাগান সৃজন করা হবে।
মানুষ বন্যহাতির ভয়ে আতংকিত জীবন যাপন করছে পাহাড়ী এলাকার মানুষ। এলাকার একাধিক গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্তের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মশাল আর ভোগা বাতি (বাঁশ ও পাট দিয়ে তৈরি মশাল) তৈরি করে রেখে দিয়েছে এবং পাহাড়ের টিলা এবং শাল-গজারি বাগানের ফাঁকে ফাঁকে আবাদি জমির উপর গ্রামবাসী ডেরা তৈরী করে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাত জেগে পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত শুকনো বাঁশের মশাল জ্বালিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে বাঙ্গালী ও উপজাতি কৃষকরা। ফসলের মৌসুমে প্রতি ডেরায় ৫ থেকে ৬ জন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ক্ষেতের চারপাশে অবস্থান নেয়। যে দল প্রথমে হাতির উপস্থিতি টের পায় সে দল চিৎকার করে উঠে। এসময় আশপাশের সকল দলের সদস্যরা ছুটে আসে হাতি তাড়াতে। এভাবেই চলছে বন্যহাতি থেকে বাঁচার নিরন্তর চেষ্টা।
নালিতাবাড়ী উপজেলার ট্রাইবাল চেয়ারম্যান মি. লুইস নেংমিনজা বলেন, বন্যহাতির জন্য অভয়ারন্য তৈরি করা হলে হাতির আক্রমন রোধ করা যেতে পারে। বন্যহাতি প্রতিরোধ নয় বরং সরকারিভাবে পুর্ণবাসন করা হলে হাতির আক্রমন বন্ধ করা যেতে পারে। অধিকাংশ গ্রাম গারো পাহাড়ী এলাকায় এরা দীর্ঘদিন যাবত নানা প্রতিকুল অবস্থার মোকাবেলা করে বন্যহাতি তাড়িয়ে আসছে। বন্যহাতি মানুষ হত্যা ও বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত করে, গাছের কাঠাল ও ক্ষেতের ফসল খেয়ে সাবার করে আসছে।
নালিতাবাড়ী সীমান্তের পোড়াগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ মিয়া বলেন, বন্যহাতির অত্যাচার বন্ধকরার জন্য সরকারিভাবে প্রয়োজনে ভারত সরকারের সহযোগিতা নিয়ে যৌথভাবে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরী বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এতে সীমান্তবর্তী পাহাড়ী গ্রামের মানুষের জান-মাল রক্ষা করা যাবে।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেলেনা পারভীন বলেন, মানুষ বনে বসতি স্থাপন করেছে। এ কারনে মাঝে মধ্যেই মানুষ ও বন্যহাতির মধ্যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ি সীমান্তঞ্চলে বন্যহাতির তান্ডব অব্যাহত থাকায় ওইসব এলকায় হাতি তাড়ানোর জন্য আতংকগ্রস্তদের মাঝে ইতোমধ্যে মশাল জ্বালাতে উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া, নয়াবিল ও পোড়াগাঁও ইউনিয়নে ২২০ লিটার কেরোসিন বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বন্যহাতির তান্ডবের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে গারো পাহাড়ে কলা গাছ লাগানো ও সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে ।