করোনা পরিস্থিতিতে বিশে^র বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পাশাপাশি সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় অনলাইনে ক্লাস হলেও বাংলাদেশে গত ১৭ মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টানা বন্ধ রয়েছে। এরইমধ্যে দেশে শিক্ষার ব্যলকনি থেকে ছিটকে পড়েছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে বিভিন্ন কর্মখানায়। বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কিশোরী। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যতদূর পিছিয়েছে, ততদূরই পিছিয়েছে শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড।
করোনার কারণে বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যে ১৪টি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে অভিভাবক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল দাবি জানিয়ে এলেও বারবার পরিকল্পনা করেও করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন মন্ত্রী-এমপি-আমলাগন। কিন্তু একজন শিক্ষা উদ্যেক্তা হিসেবে, বাংলাদেশের রাজপথে থাকার পাশাপাশি শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ার জন্য নিবেদিত থাকার সুবাদে বলতে পারি যে, জাতির কষ্টসময় চলছে।
তারও অ- নে-ক পরের কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশ দেওয়ার পর নতুন করে আলোচনা ও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সব শঙ্কা ও সংশয়ের অবসান হয়েছে বলে গণমাধ্যমে বড় বড় লেকচার প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশ করছেন তথাকথিত কিছু গৃহপালিত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? তিনি বলছেন, করোনার সংক্রমণের পরিস্থিতি সুবিধাজনক অবস্থায় এলে এবং টিকা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। সরকারের নির্দেশনা মতো টিকাদান, প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণের মতো বিষয়গুলো দ্রুতই এগোচ্ছে। এখন শুধু চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্তে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ও ক্লাস চালু করার ব্যাপারে অনেক আগে থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও হলে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ২ লাখ নিবন্ধন করেছেন। এরমধ্যে পর্যন্ত ৯০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রথম ডোজ টিকা সম্পন্ন হয়েছে। ২য় ডোজ নিয়েছেন ২২শ’র মতো শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বিতীয় ডোজের সংখ্যা মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। কর্মচারীদের অবস্থাও প্রায় একই রকম চিত্র।
টিকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে কিভাবে দিয়ে শেষ করা হবে? কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে? তার কোন সঠিক সুপরিকল্পনা নেই। যে কারণে নির্মাণ হয়েছে ছাত্র-শিক্ষকদের টিকাবাহিনীর অসমাপ্তকাহিনী। এরইমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিকা কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সচিব ডক্টর ফেরদৌস জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, গণটিকা দেওয়ার কয়েকদিন কিছুটা কম থাকলেও এখন পুরো দমে টিকা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই টিকা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন চলছে। ঢাকার ৭ কলেজের ২ লাখ আবাসিক শিক্ষার্থীর তালিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জমা দেওয়া হবে। এরপর সেগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন কলেজগুলোর সমন্বয়কারী ঢাকা কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক আইকে সেলিমুল্লাহ খোন্দকার। অন্যদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিবন্ধিত হয়েছেন ১০ লাখের মতো। সম্প্রতি তাদের টিকা নিজ উদ্যোগে নেয়ার কথা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ফায়জুল করিম। ফলে সময়মতো বা অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে তারাও বাদ পড়তে যাচ্ছেন। এদিকে, উচ্চমাধ্যমিককলেজ ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়সমূহ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রায় ৮০ শতাংশের উপরে টিকা দান সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে অধিকাংশের এক ডোজ দেওয়া হয়েছে। তবে, দ্বিতীয় ডোজের সংখ্যা খুবই কম বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এখানকার শিক্ষার্থীরা টিকার আওতায় পড়েনি বয়সের কারণে। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষক এবং কর্মচারীদের টিকা কার্যক্রম সম্পর্কে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন-কলেজ) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী গণমাধ্যমের সাথে আলোচনা বলেন, টিকা কার্যক্রম চলছে। প্রথম ডোজ দেওয়া এখনো শেষ হয়নি।
এমন শঙ্কা আর অপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ এখনো চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কার কাজ চলমান বলে জানিয়েছে ইউজিসি। শতভাগ প্রস্তুতি এখনো শেষ করতে পারেনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পাশাপাশি সচিব-আমলা-মন্ত্রী-এমপিদের একেক সময় একেক সিদ্ধান্তর কারণে নির্মিত অপরিকল্পনায় অন্ধকার এগিয়ে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেছেন, সরকার ঘোষণা দিলেই প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সব প্রস্তুতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে। আমরা তদারকিও করছি নিয়মিত। শিক্ষকদের টিকা দান প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া অধিকাংশ জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে 'ওয়াশ রুম' তৈরি ও সাজানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাত ধোয়ার নতুন বেসিন বসানো হয়েছে। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে থার্মার স্ক্যানার কেনা হয়েছে। কিন্তু দেশের দারিদ্র্যপীড়িত ১৪ জেলা এবং প্রত্যন্ত এলাকা বিশেষ করে হাওড় এলাকার জেলাগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয় অনেকটাই নাজুক বলে জানা গেছে। সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুসারে আগামী ৩০ আগস্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শেষ না হওয়ার কারণে সেই সম্ভাবনাও এখন ঝুলে আছে অন্ধকারের হ্যাঙ্গারে। এখান থেকে উত্তরণ প্রয়োজন, প্রয়োজন নীতিগত সিদ্ধান্ত।
যদিও জীবনের রঙধনু নিয়ে এগিয়ে চলা শিক্ষাব্যবস্থায় কালোমেঘের খেলা থেকে বাঁচার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দেশনায় অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দূর হয়েছে বলে আমি মনে করি; কিন্তু এজন্য প্রয়োজন টিকা কার্যক্রম সফল করা। শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, সারাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষকদের টিকার আওতায় আনা না গেলে অভিভাবকদের উদ্বেগের অবসান হবে। সে ক্ষেত্রে টিকা কার্যক্রমকে আরও জোরদার করে প্রি-প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। কেউ যেন বাদ না যান। সারাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্য থেকে কমপক্ষে ২ কোটি টিকা নিশ্চিত করতে হবে। তা না করতে পারলে বরাবরের মত বলতে হবে যে, দীর্ঘ সময় শিক্ষা নিয়ে কর্মরত এ শিক্ষা বিশেষজ্ঞ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি আটকে যেতে পারে। যদিও শুরু থেকেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতির কথা বলে আসছেন। কিন্তু প্রস্তুতি মনিটরিং হচ্ছে কি না, বা হয়েছে কি না তা জানা নেই খোদ শিক্ষা সচিব-মন্ত্রণালয়ের। তাদের কাছে প্রস্তুতি কতটুকু এখন আছে তাও স্পষ্ট নয়। আমি মনে করি- প্রায় ছয় মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার একটি সুযোগ ছিল। গত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশের অনেক স্থানে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক কম ছিল। সে সময় খুলে দেওয়া হলে বা বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষাগুলো নেওয়া শুরু করা গেলে প্রস্তুতি সম্পর্কে একটি পরিমাপ ও ধারণা পাওয়া যেত। সে সুযোগ আমরা হারিয়েছি। এত কিছুর পরও বাস্তবতা হলো- শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে অনেক সময় লাগবে। তারপরও এখন থেকেই যেন তার পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আক্ষরিক অর্থে বলা যায়- সব মহলের উদ্বেগের অবসান হয়েছে। নির্দেশনা অনুসারে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার। বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিককর্মকান্ডে নিবেদিত থাকা কর্মী হিসেবে বলতে পারি যে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে খুলে দেওয়ার বা একসঙ্গেই সব কিছু করতে হবে- এমন ধারণা ও প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। করোনা আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। শিক্ষার এককেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে বা যে এলাকায় সংক্রমণ কম সেখানে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী অনেক বেশি। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশের যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম এবং যে এলাকায় সংক্রমণ কম সে সব এলাকায় অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রাঙামাটি বা পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। ঢাকায় বসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার চিন্তা বা পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ করার নির্দেশনা যেহেতু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন, তা মনে রেখে ক্ষয়ে যাওয়া এই সমাজের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। মনে রাখতে হবে- সংক্রমণ দেশের সব এলাকায় একরকম নয়, যেখানে কম রয়েছে বা ছিল সেখানে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া উচিত। এমন করে ভাবতে হবে সবাইকে করতে হবে আলোর পথে চলার শপথ, রাখতে হবে ভালোর পথে বলার হিম্মত...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি এবং প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় শিক্ষাধারা