এক সময়ের বিলুপ্তপ্রায় বিষধর চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপার সাপের আবাস এখন রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর। সেইসঙ্গে আছে আরেক বিষধর সাপ ক্রেইট বা কালাচ। তবে বর্তমানে পদ্মার প্রায় সবগুলো চর এখন পানিতে ডুবে যাওয়ায় সাপগুলো উঠছে তীরে। ঢুকে পড়ছে বাড়িতেও। এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে পদ্মাপাড়ের বসতিদের। আর তাই দেখামাত্রই পিটিয়ে মারা হচ্ছে এসব সাপ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সাপের গবেষকেরা।
এখন প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও রাসেল ভাইপার সাপকে পিটিয়ে হত্যার পর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছাড়া হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে রাজশাহীর একজন সাব গবেষক হিসাব করে দেখেছেন, সম্প্রতি চার দিনেই রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নাটোর ও ফরিদপুরে ১৬৭টি সাপ মেরে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে ১০৭টিই রাসেল ভাইপার। অন্যগুলোর মধ্যে আছে ক্রেইট বা কালাচ এবং কোবরা জাতের সাপ।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ২৫, ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে একটি কালাচ। পরে সাপটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সম্প্রতি গোদাগাড়ী উপজেলার শেকরমারি গ্রামের আদিবাসী গৃহবধূ আদরী সর্দারকে সাপে কাটে। আদরী রাতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। বিছানার ওপরেই সাপ উঠে পায়ে কাটে। আদরীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারের সদস্যরা সাপটিকেও মেরে হাসপাতালে এনেছিলেন চিকিৎসককে দেখানোর জন্য। তখন মৃত সাপটিকে দেখে চিকিৎসকেরা জানান, এটি বিষধর ক্রেইট বা কালাচ। এই সাপটি গোখরার চেয়েও বিষধর।
জানা গেছে, সম্প্রতি পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে বিষধর সাপের কামড়ে আমজাদ হোসেনের (৬০) মৃত্যু হয়েছে। নিহত আমজাদ হোসেন রঘুরামপুর গ্রামের মৃত রশিদ মোল্লার ছেলে। জানা যায়, গভীর রাতে ঘুমের মধ্যেই তাকে সাপে দংশন করে। কিন্তু ইঁদুর কামড় দিয়েছে ভেবে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি আবারও ঘুমিয়ে যায়। এরপর ভোর রাতের দিকে তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু তখন চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং বিসাক্ত সাপের দংশনেই তার মৃত্যু হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, আমাদের হাসপাতালে সর্পদংশন রোগীর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভেনাম রয়েছে। ফলে কাউকে সাপে কামড়ালে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আনলে এ চিকিৎসা সেবা পাবে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) জেনেটিক বিভাগের অধ্যাপক আবু রেজা বলেন, বিষধর প্রজাতির সাপগুলো সাধারণত বালুচরে থাকে। এখন চর ডুবে গেছে। তাই রাসেল ভাইপার চর থেকে উঠে নদীর তীরবর্তী পাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে। আর কালাচ সাধারণত বরেন্দ্র অঞ্চলে থাকে। তবে নদীর তীরেও সাপটির দেখা মেলে। নিশাচর সাপটি ঘুমের মধ্যে থাকা মানুষকে বিছানায় উঠেও কামড়ায়। বর্ষাকালে কালাচেরও আবাস ডুবে যাওয়ায় সাপটি গৃহস্থের বাড়িতে যাচ্ছে। এ কারণে বর্তমান সময়ে সকলকেই সাবধানতা অবলম্বন করে চলাফেরা ও বসবাস করতে হবে।
রাজশাহীর পবা উপজেলায় একটি সাপ উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন বোরহান বিশ্বাস রোমন। এই সাপ গবেষক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন। এ ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে সাপ উদ্ধার করে থাকেন। এই বোরহান বিশ্বাস জানিয়েছেন, কালাচ সাপটি দেশের অন্যান্য স্থানে তেমন দেখা না গেলেও রাজশাহীতে এর বিচরণ যথেষ্ট। এর পাশাপাশি রাজশাহীতে চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপারও পর্যাপ্ত সংখ্যক দেখা যাচ্ছে। তিনি জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় প্রচুর রাসেল ভাইপার ছিল। দিনে দিনে সেসব বিলুপ্ত হয়ে যায়। গত ২০১০-১১ সালের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বন্যার পানিতে ভেসে রাজশাহী আসে। এরপর থেকেই পদ্মার চরাঞ্চলে সাপটি যত্রতত্র দেখা যায়। এরা চরের পাখি, ইঁদুর ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এখন চরগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় সাপগুলো নদীতীরে উঠে আসছে। এই রাসেল ভাইপার গাছে উঠতে পারে না। তাই কুচুরি পানা বা কোনো বস্তু আঁকড়ে ধরে। এরপর কয়েলের মতো হয়ে নিজের শরীর ফোলায়। এতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূর যেতে পারে রাসেল ভাইপার। তবে এভাবে আসার পথে জেলেদের জালেও সাপগুলো আটকা পড়ছে। কিন্তু এই সাপ দেখামাত্রই আতঙ্কিত হয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতি। পরোক্ষভাবে মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাসেল ভাইপার মারতে গিয়েও মানুষ সমস্যায় পড়তে পারে। এর ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা নেই। এই সাপ দংশন করলে বিষ দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ওই দেহে পচনও ধরে যায়। তবে সঠিক চিকিৎসা পেলে আশঙ্কার কিছু নেই।
তিনি বলেন, অধিকাংশদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, রাসেল ভাইপার সাপে কামড়ের চিকিৎসা বাংলাদেশে হয় না। আর এসব প্রচারের কারণে রাসেল ভাইপার দেখলে মানুষ মেরে ফেলছে। তাই জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, বাংলাদেশে রাসেল ভাইপার সাপে কমড়ের চিকিৎসা হয়। এখন দেশের সব জেলা শহরের হাসপাতালেই রাসেল ভাইপারের ভেনম আছে। কিন্তু মানুষ প্রথমেই হাসপাতালে না এসে ওঝার কাছে যায়। ফলে মৃত্যুর হারও বাড়ে।
বোরহান বিশ্বাস বলেন, সাপ নিয়ে আতঙ্ক থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ব্যাপারে সচেতনতারও দরকার আছে। বেশি করে সাপ উদ্ধারকারী তৈরী করতে পারলে এ সমস্যা কেটে যাবে। প্রাকৃতিক উপায়েও রাসেল ভাইপার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেখানে রাসেল ভাইপার আছে সেখানে সঙ্খিনি সাপ ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এই সাপ রাসেল ভাইপার খেয়ে ফেলে। সঙ্খিনিও বিষধর সাপ। তবে এই সাপ মানুষকে তেমন একটা কামড়ায় না। গত ৫০ বছরে সঙ্খিনি সাপ মাত্র একজনকে কামড়ানোর রেকর্ড আছে। ফলে এই সাপের মাধ্যইে রাসেল ভাইপার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।