দেশের অধিকাংশ রেলপথই বহু বছরের পুরোনো। আর ওই রেলপথ প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না হওয়ায় অহরহ ট্রেন দুর্ঘটনা ও লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া লাইন আর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেতুর কারণে অনেক এলাকাই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ফলে ট্রেনের গতি বাড়লে অথবা কোনো ক্ষেত্রে সামান্য গতিতে এমন ঘটনা ঘটছে। অথচ রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য প্রতিবছরই বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা আর লাইনচ্যুতের ঘটনায় উন্নয়নের যথাযথ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের রেলপথে অহরহ ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও লাইন রক্ষণাবেক্ষণে নজর নেই। লোক দেখানো সংস্কারের নামে সরকারের বিপুল টাকা ব্যয় হলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। করোনাকালে লকডাউনে দেশের রেলপথে অনেকদিন ট্রেন চলাচল করে। ওই সময়েও ফাঁকা রেলপথে লাইন সংস্কার করা হয়নি। সম্প্রতিককালে অন্তত এক ডজন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া লাইনের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সেট ভেঙে যাওয়ায় সম্প্রতি একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ১২ আগস্ট ভৈরব, গাজীপুরে ৩টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। ১৪ আগস্ট দিনাজপুর-পার্বতীপুর লাইনের কাঞ্চন মেইল এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়। চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে এক সপ্তাহে আরো ৩ বার ট্রেনের লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটে। গত ২০ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি রেলওয়ে এলাকায় পয়েন্ট সেট ভাঙা ছিল। এলাকাবাসীর বুদ্ধিমত্তায় একটি যাত্রীবাহী ট্রেন দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। বিগত কয়েক বছরে রেলওয়ের বহরে আধুনিক ইঞ্জিন ও কোচ যোগ হলেও ট্রেনের গতি বাড়েনি। ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতির ট্রেন চালু হলেও গড় গতি ৭০ কিলোমিটারের নিচেই থাকে। রেলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে এবং সমাপ্তও হচ্ছে। একই সঙ্গে বড় বড় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় প্রকল্পও হাতে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু রেলপথ সংস্কারে কার্যকর কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে না। ট্রেনের প্রতিটি লাইনচ্যুতির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয় কিন্তু কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রেলপথ সংস্কার হয় না । ট্রেন পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের মতে, জরাজীর্ণ-আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া রেলপথে ট্রেন চালালে লাইনচ্যুত হবেই। চালকরা বরং গতি কমিয়ে ট্রেন চালায় বলে কিছুটা কম লাইনচ্যুতি ঘটছে। নাহলে প্রতিদিনই লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটতো। লাইনচ্যুত কেবল জরাজীর্ণ লাইনের কারণেই ঘটে। পূর্বাঞ্চল রেলে ৫০-৬০ বছরের পুরোনো লাইনও রয়েছে। সেজন্য কিছু এলাকায় একেবারেই গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে হয়। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত লাইনের বর্তমান বয়স অর্ধশতেরও বেশি। ওসব লাইন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া আখাউড়া থেকে সিলেট রেলপথেও পুরাতন ট্র্যাক, জরাজীর্ণ লাইন রয়েছে। ওই অঞ্চলে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রেলপথ খুবই পুরাতন এবং ট্র্যাকের আয়ুও শেষ। তবে রেললাইন সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
সূত্র আরো জানায়, লকডাউনের মধ্যে খুব সহজেই লাইন সংস্কারের কাজ করা যেত। আর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখে লাইন সংস্কারের কাজ খুব ধীরগতিতে করতে হয়। নির্ধারিত সময়ে লাইন সংস্কার করতে ট্যাম্পিং মেশিনের প্রয়োজন। মাত্র ৬টি ট্যাম্পিং মেশিনের মধ্যে ৪টিই নষ্ট। বারবার ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় ইঞ্জিন-কোচ ও রেলপথের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যাত্রীদের দুর্ভোগের সঙ্গে বাড়ে শিডিউল বিপর্যয়ও। ট্রেনের যাত্রা বাতিলসহ বিক্রি হওয়া টিকিট সমমূল্যে ফেরত দিতে হয়। গত সাত বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার জন্য মূলত তিনটি বিশেষ কারণ পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে- মানুষের ভুল, কারিগরি ত্রুটি এবং জরাজীর্ণ লাইনের কারণে লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটছে। লাইনচ্যুতির জন্যই রেল দুর্ঘটনাগুলোর ৯৫ শতাংশই ঘটে। গত এক যুগে রেলে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরো ৪৩টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু চলমান রেলপথ উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি।
এদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান জানান, ট্রেন লাইনচ্যুতির সঙ্গে যাত্রী দুর্ভোগ, ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ছে। তবে গত বছরের চেয়ে লাইনচ্যুত-দুর্ঘটনা কমে এসেছে। রেলের রাজস্ব থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকায় লাইন সংস্কার এবং পুরাতন ট্র্যাক বদলাতে কাজ শুরু করা হয়েছে। লাইনচ্যুতের ঘটনায় ট্রেনের সঙ্গে রেলপথেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা জানান, ট্রেন লাইনচ্যুতির অন্যতম কারণ হচ্ছে সংস্কারহীন রেলপথ। তাছাড়া আরো অনেক কারণ আছে। রেলপথ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মজবুত লাইনে লাইনচ্যুত হওয়ার কথা নয়। চলমান রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরাতন ট্র্যাক পুনর্বাসনে জোর দেয়া হচ্ছে। জরাজীর্ণ রেলপথে ক্লিপ, নাটবল্টু, হুক, ফিশপ্লেটসহ পাথর আছে কিনা তা নিশ্চিত করা হবে। প্রতিবছরই বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা আর লাইনচ্যুতের ঘটনায় উন্নয়নের যথাযথ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া লাইন এবং জরাজীর্ণ রেলপথ পুনর্বাসনবিহীন দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে না। আশা করা যায় আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করা যাবে।