বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বাজারে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বিক্রি হচ্ছে। অথচ বিইআরসি মাত্র এক মাস আগে বিশ্ববাজারের সাথে মূল্য সমন্বয় করে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু দেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিইআরসির নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করেই এলপিজি সিলিন্ডারের জন্য নতুন মূল্য নির্ধারণ করে এবং ব্যবসায়ীরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভোক্তাদের কাছ থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম আদায় করছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) নামমাত্র মূল্যে এলপিজি বিক্রি করলেও বেসরকারি কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত দামে এলপিজি বিক্রি করছে। আর এলপিজির বাড়তি দামে করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রাহকরা পড়েছে চরম বিপাকে। বিইআরসি, বিপিসি এবং ভোক্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিইআরসি চলতি বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারে মূসকসহ ৮৯১ টাকা থেকে ১০২ টাকা বাড়িয়ে ৯৯৩ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়। যা আগস্ট মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। উচ্চ আদালতের দেয়া এক আদেশ বাস্তবায়ন করতে বিইআরসি পক্ষ থেকে চলতি বছর এপ্রিলে প্রথমবার দেশে সরকারিভাবে এলপিজির দর নির্ধারণের ঘোষণা আসে। বিভিন্ন দেশ থেকে এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রপেন ও বিউটেন আমদানি করা হয়। সৌদি আরামকো প্রতি মাসে এলপিজির ওই দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে। যা কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। ওই সৌদি সিপি ভিত্তি মূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বেসরকারি এলপিজি বিক্রেতারা শুরু থেকেই দাম নির্ধারণের বিষয়টি মেনে নেয়নি। ফলে বিইআরসি দর নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে কোনক্রমেই এলপিজির দাম কমানো হবে না বলে ব্যবসায়ীদের পক্ষ জানানো হয়।
সূত্র জানায়, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে আসছে এমন অজুহাতে গত কয়েক বছর ধরে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। আবার যাদের সংযোগ আছে তাদেরও অনেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস পাচ্ছে না। ফলে দৈনন্দিন রান্নার চাহিদা মেটাতে দিন দিন এলপিজির চাহিদা বাড়ছে। আর ওই সুযোগে বেসরকারি কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ইচ্ছামতো আদায় করছে। বর্তমানে রাজধানীতে এলপিজির খুচরা বাজারে ব্যবসায়ীরা ১২ কেজির একটি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ১১শ’ থেকে ১২শ’ ৫০ টাকা নিচ্ছে। একইভাবে ৩৫ কেজির দাম নেয়া হচ্ছে ২৯শ’ থেকে ৩২শ’ টাকা, ৪৫ কেজির দাম ৩৯শ’ থেকে শুরু করে ৪২শ’ টাকা পর্যন্ত। অথচ বিইআরসি নির্ধারিত আগস্ট মাসের জন্য এলপিজির মূল সমন্বয়ের আদেশে বলা হয় ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম সিপি ৬৩২ (কনট্রাক্ট প্রাইস) টাকাসহ, ভাড়া এবং ট্রেডারের প্রিমিয়াম চার্জ, অন্যান্য চার্জ, ইমপোর্ট প্রাইস, মজুদকরণ ও বোতলজাতকরণ চার্জ, মূসক চার্জ, ডিস্ট্রিবিউটর চার্জসহ (পরিবহন ব্যয়সহ) ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য হবে ৯৯৩ টাকা। একইভাবে ২৫ কেজি সিলিন্ডারের জন্য সর্বোচ্চ দাম আদায় করা যাবে ২ হাজার ৬৮ টাকা, ৩৫ কেজি সিলিন্ডারের দাম রাখা যাবে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮৯৬ টাকা এবং ৪৫ কেজির দাম রাখতে হবে ৩ হাজার ৭২৩ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে দেশে এলপিজির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১০ লাখ টন। তার মধ্যে বিপিসি মাত্র ১৬ হাজার টন সরবরাহ করছে। আর সরকারি এলপিজি কোম্পানির দুটি কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৫ হাজার ৫০০ টন। তার মধ্যে চট্টগ্রামের এলপিজি কারখানার ১০ হাজার আর কৈলাসটিলা প্ল্যান্টে উৎপাদন হয় ৫ হাজার ৫০০ টন। বিপিসির সর্বশেষ নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের সরকারি মূল্য ৫৯১ টাকা। সরকারের নিজস্ব উৎপাদিত ওই এলপিজি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হলেও তা সাধারণের জন্য দু®প্রাপ্য। ফলে ভোক্তাদের বাধ্য হয়েই বেসরকারি কোম্পানির সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর চাহিদার প্রেক্ষিতে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রিও হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, টোটাল, বিএম এলপি গ্যাস, এনার্জিপ্যাকের জি গ্যাস, লাফ্স গ্যাস, ইউরোগ্যাস, ইউনিভার্সাল, যমুনা ও সেনা এলপিজি। ওসব প্রতিষ্ঠান বিপিসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেশি দামে অর্থাৎ ১১ থেকে ১২০০ টাকায় এলপিজি বিক্রি করছে। এমআরপি অর্থাৎ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ না থাকায় তারা ইচ্ছা মতো মূল্য আদায় করছে।
এদিকে এলপিজির খুচরা বিক্রিতাদের মতে, কোম্পানি নির্ধারিত দামেই খুচরা ব্যবসায়ীদের এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করতে হয়। বিইআরসি কি দাম নির্ধারণ করেছে তাতে খুচরা ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই। কোম্পানিগুলো থেকেই ব্যবসায়ীরা সিলিন্ডার নিয়ে থাকে এবং তাদের নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করতে হয়। আর সরকারি সিলিন্ডার তো খুচরা ব্যবসায়ীরা বলতে গেলে পায়ই না। ফলে বাধ্য হয়েই খুচরা বিক্রিতাদের বিভিন্ন কোম্পানির এলপিজি সিলিন্ডারই বিক্রি করতে হয়। সেজন্য তাদের পক্ষে এলপিজির সরকার নির্ধারিত দাম রাখার সুযোগ নেই। কোম্পানি যা নির্ধারণ করে দেয় তাই আদায় করতে হয়। খুচরা পর্যায়ে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার এলপিজি কেনা পড়ে প্রায় ১০০০ টাকা। বিক্রি হয় ১১শ’ টাকায়। বাসায় পৌঁছে দিলে ১২শ’ টাকা নেয়া হয়।
অন্যদিকে এলপিজির বাড়তি দাম আদায়ের অভিযোগ মানতে রাজি নয় বেসরকারি কোম্পানিগুলো। তাদের মতে, কোম্পানি পর্যায় থেকে সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার প্রাইজ ৭৮০ টাকা। আর সেটি এক বা দুই হাত ঘুরে ভোক্তাপর্যায়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি হয় সাড়ে ৮শ’ থেকে ৯০০ টাকায়। সরকারের দামের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দামের পার্থক্য হওয়ার কারণ হচ্ছে সরকার নিজেরা উৎপাদন করে আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তা আমদানি করে। সরকার উৎপাদন করে বিধায় নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে পারে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির মূল্য ওঠানামা করে। বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম বাড়লে দেশেও বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ জানান, এলপিজির দাম বাড়ার মূল কারণ বিপিসি বাজারের চাহিদার মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ সরবরাহ করতে পারে। বাকি ৯৮ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে। সেজন্য বিপিসি এলপিজির দাম কমালেও বাজারে তেমন প্রভাব পড়ে না। বেসরকারি কোম্পানিগুলো এলপিজি আমদানি করে মূল্য নির্ধারণ করে বাজারে ছাড়ে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তাদের ওই সুযোগ দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জানান, নির্দিষ্ট কোন নীতিমালা না থাকায় এলপিজি ব্যবসায়ীরা এমন স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ পাচ্ছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা যেন সব কিছুর উর্ধে। তাদের কোন নিয়মনীতি মানতে হয় না। এলপিজি আমদানি এবং বিক্রি নিয়ে নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলেও দাম নিয়ন্ত্রণে বিইআরসির আদেশ রয়েছে। কিন্তু তারা তা মানে না। অথচ যে মূল্য তালিকা তারা মানে না সেটার আবার দাম নির্ধারণের জন্য গণশুনানির আবেদন করে। যা মানা হয় না তার আবার নতুন করে দাম নির্ধারণের কি আছে? সেজন্যই গণশুনানির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। কারণ এলপিজির দাম আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।