দেশের আড়তগুলোতে মজুদকৃত লবণযুক্ত কোরবানীর চামড়ার দাম কমাতে ট্যানারি মালিকরা নানা কারসাজিতে লিপ্ত। নানা অজুহাতে তারা মজুদকৃত লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে আড়ত মালিকরা সরকার নির্ধারিত দাম না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাক ভর্তি চামড়া ঢাকায় এনে বিক্রি না করেই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বিক্রি করলেও করতে চাইলেও তা কম দামে বাকিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে ট্যানারিতে ওসব চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু না হলে তা পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার চাহিদা ও রফতানি বাড়লেও ট্যানারি মালিকদের কারসাজিতে অভ্যন্তরীণ মার্কেটে কাঁচা চামড়া নিয়ে সঙ্কট তৈরি আশঙ্কা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ এবং সরবরাহ চেইনে গতিশীলতা বজায় রাখতে আড়ত মালিকদের জেলাভিত্তিক তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত এবং ওই খাতের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বেশকিছু কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। দেশের চামড়া খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাধারণত রাজধানীর পোস্তার আড়ত থেকে জুলাই মাসের শেষদিক থেকেই ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করে। তবে এবার চামড়া বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। এখন পর্যন্ত আড়তের মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। অথচ অন্যান্যবার এই সময়ে প্রায় ৬০ শতাংশ চামড়াই বিক্রি হয়ে যেত। লবণযুক্ত চমড়া দেড় থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস পর্যন্ত ভাল থাকে। তারপর থেকেই নষ্ট হতে শুরু করে। তখন ওই চামড়া ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। কিন্ত এবার ট্যানারি মালিকরা আর্থিক সঙ্কটের অজুহাতে চামড়া কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে সারাদেশের আড়ত ও মোকামের চামড়া বিক্রি কমে একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আর নগদ টাকার সঙ্কটের কথা বলে ট্যানারিগুলোর পক্ষ থেকে কমদামে বাকিতে চামড়া কেনা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আড়ত মালিকদের অনেকেই লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তাদের ওসব চামড়া নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে ট্যানারি মালিকদের মতে, আন্তর্জাতিক চাহিদা ও মূল্যের ওপর চামড়ার দাম কমার বিষয়টি নির্ভর করে। বর্তমানে বাজার মন্দা থাকায় অভ্যন্তরীণ মার্কেটেও দাম কমে গেছে। ওরকম নানা অজুহাতে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই আড়ত মালিকদের অনেকে লোকসানের মুখে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া বিক্রি করে দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং নাটোরের বড় বড় আড়তে চামড়ার স্তূপ জমে থাকলেও বিক্রি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি তৈরি জন্য ট্যানারি মালিকদের দায়ি করা হচ্ছে। আড়তের চামড়া বেচাকেনা না হওয়ার বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। সেজন্য সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আড়তদারদের জেলাভিত্তিক তালিকা চাওয়া হয়। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলার আড়তদার ব্যবসায়ীদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জেলা পর্যায়ের সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে ওই তালিকা ঢাকায় আনা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোরবানির কাঁচা চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে বলে জানানো হয়।
সূত্র আরো জানায়, আড়তে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা লবণযুক্ত চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজিতে ভবিষ্যতে চামড়া খাতে নেতিবাচক প্রভাবের তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। কারণ আড়তদাররা সঠিক দাম না পেলে ভবিষ্যতে তারা কোরবানির চামড়া সংগ্রহে আগ্রহী হবে না। ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে সর্বোচ্চ ১৫-২০ লাখ চামড়া আসলেও বাদবাকি সব চামড়া রাজধানীর বাইরে থেকে আসে। চলতি বছর ট্যানারিগুলো গবাদিপশু থেকে প্রায় ৯০ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে। আগামী দুই থেকে তিন মাস নাগাদ সারাদেশ থেকে পশুর চামড়া সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে আনা হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সারাদেশে এবার ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। তার মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে সারাদেশ থেকে এবার ৪০ লাখ গরু-মহিষ এবং ৫০ লাখ ছাগল-ভেড়ার চামড়া পাওয়া যাবে। তাতে ট্যানারিগুলোতে সারাবছরের প্রায় অর্ধেক চামড়া আসবে। ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২২ লাখ ৩৯ হাজার কোরবানি হয়েছে এবং ময়মনসিংহ বিভাগে সবচেয়ে কম ৩ লাখ ৪৭ হাজার গবাদিপশুর কোরবানি হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম বিভাগে গরু-মহিষের কোরবানি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ওই সংখ্যা ১০ লাখ ৭১ হাজার, যা ঢাকা বিভাগের চেয়ে প্রায় ১ লাখ বেশি।
এদিকে রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার সুবাদে পোশাক শিল্পের মতো চামড়া খাতের ট্যানারি মালিকরা সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। সাভারের হেমায়েতপুরে নামমাত্র মূল্যে ১৫৫টি ট্যানারিকে জমি বরাদ্দসহ বিভিন্ন অবকাঠামো করে দেয়া হয়েছে। তাতে সরকারের দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে ফিনিশড চামড়া রফতানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা রফতানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। চামড়া শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় মেশিনারি আমদানিতে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিবছর কোরবানির সময় বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়। দেশে চামড়া শিল্পের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও লেদারগুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড ইমপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) উদ্যোগে গতবছর একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। তখন ১৫টি দেশের চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতারা ওই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে। তার আগে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে সরকার প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার হিসেবে ঘোষণা করে। চামড়া শিল্পে দেশের প্রত্যক্ষভাবে ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাছাড়া পরোক্ষভাবে কাজ করে প্রায় ৬ লাখ মানুষ। রফতানিতে চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের অবস্থান দ্বিতীয়। গত কয়েকবছর ধরে রফতানিতে নেতিবাচক ধারা বজায় থাকলেও সর্বশেষ গতবছর চামড়া খাতে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পাকা চামড়া বা ফিনিশড লেদারের চাহিদা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির সুযোগ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যে কারণে চামড়া রফতানিতে ইতিবাচক ধারা ফিরে এসেছে। এমন অবস্থায় চামড়া খাত সংশ্লিষ্টরা লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার কথা বলছে।
অন্যদিকে কাঁচা চামড়া সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা এবং চামড়া শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আরন্ দুটি চামড়া শিল্পনগরী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে ৪ বছর আগে তার অবকাঠামো উন্নয়ন নির্মাণের ঘোষণা থাকলেও বাস্তবায়নে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। তবে খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, দ্রুত আরো দুটি শিল্পনগরী হলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়বে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) থেকে গত কয়েকবছর ধরেই বলা হচ্ছে, কোরবানি ঈদ থেকে গরু-ছাগল মিলিয়ে ৮০ লাখ কাঁচা চামড়া পাওয়া যায়। বাকি চামড়াগুলো বিভিন্ন কারণে পচে যাওয়াসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। তবে গত কয়েক বছর ধরে সারাদেশে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর ফলে এখন আর তেমন চামড়া নষ্ট হয় না।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাণিজ্য সচিব তপনকান্তি ঘোষ জানান, সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া বেচাকেনা করতে হবে। তার বাইরে চামড়া বেচাকেনার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সরকার নমনীয় হবে না। বরং কঠোর ও কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য থাকবে।