দেশে প্রতি বছরই সামাজিক নিরাপত্তার ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ায় সরকার বাজেট বরাদ্দও বাড়াচ্ছে। কিন্তু জনবলের তীব্র সঙ্কটে ভাতাভোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে। কারণ গত প্রায় দু’যুগেও ভাতাভোগীদের সেবা প্রদানে সমাজকল্যাণ খাতে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না।
প্রায় এক কোটি ভাতাভোগীকে অনলাইন সেবা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হলেও কারিগরি কোনো পদ সৃজন করা হয়নি। তাছাড়া এক হাজার ৭৪০টি ইউনিয়নে কোনো ইউনিয়ন সমাজকর্মী নেই। এমনকি একজন সমাজকর্মীর ১৪টি ইউনিয়নে কাজ করার উদাহরণ রয়েছে। ফলে নিয়মিত ভাতা পরিশোধ বই লেখা, অনলাইনে ভাতা পেতে মোবাইল নম্বর যুক্ত করা, এনআইডির সমস্যা এবং ব্যাংক হিসাবে টাকা পৌঁছাতে বিলম্বসহ নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে ভাতাভোগীরা।
জনবল সঙ্কটে লাখ লাখ ভোতাভোগীর বাছাই, বাস্তবায়ন কমিটির সভা, মৃতদের প্রতিস্থাপন, অপেক্ষমাণ তালিকা তৈরি, মনিটরিং, প্রতিবন্ধীদের জরিপসহ অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সচেতনতা ও আয়বর্ধক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বিগত ১৯৭৪ সালে পল্লী সমাজসেবা (আরএসএস) কার্যক্রম শুরু হয়। তারপর দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ ২৩ বছরেও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ে কোনো পদ সৃজন করা হয়নি। ফলে ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে আশির দশকে আরএসএস কার্যক্রমে নিয়োগ পাওয়া কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাজ করছে।
আরএসএসের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার অতিরিক্ত কাজ করায় উভয় কাজের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু শূন্য পদ পূরণে বিলম্ব করছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির দুই শতাধিক পদ শূন্য রয়েছে। অথচ সমাজসেবা অধিদপ্তর সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে নগদ আর্থিক সহায়তা-সংক্রান্ত সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। তখন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটি। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
সূত্র জানায়, শিবগঞ্জ উপজেলায় সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের সেবাগ্রহীতার সংখ্যা প্রায় অর্ধলাখ। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে মাত্র ১৮ জন। ৩ বছর আগে কর্তৃপক্ষের কাছে নতুন পদ সৃজনের প্রস্তাব দেয়া হলেও এখনো তা অনুমোদন হয়নি। নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে সমাজকর্মীর কোনো পদ নেই। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১৪টি ইউনিয়ন, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে ১৩টি, দিনাজপুরের খানসামায় ৬টি, বরগুনার আমতলীতে ৮টি এবং ফরিদপুর সদরে ও বগুড়ার শাজাহানপুরে ৯টি করে ইউনিয়নে মাত্র একজন করে সমাজকর্মী রয়েছে। মূলত জনবলের অপর্যাপ্ততা ভাতাভোগীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বয়স্ক, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা এবং শিক্ষা উপবৃত্তি উপকারভোগী ৮৮ লাখ ৫০ হাজার জনের মধ্যে গত ৩১ জুন পর্যন্ত ৮৭ লাখ ৬৩ হাজার জনের অনলাইনে সেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরে ১৫০টি উপজেলায় সাড়ে ১২ লাখ ভাতাভোগীর অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ সমাজসেবা অধিদপ্তরে তথ্যপ্রযুক্তির (আইসিটি) কোনো পদ নেই। ডিজিটাল যুগে লাখ লাখ সেবাগ্রহীতার একটি প্রতিষ্ঠানে আইসিটির কোনো পদ না থাকায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পদ সৃজনের আগেই আইসিটিতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো দক্ষ করে গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।
তাছাড়া আশির দশকের যেসব পদের কোনো কাজ নেই, সেগুলো বিলুপ্ত করে নতুন পদ রূপান্তর করা যেতে পারে। বিগত ২০১৮ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সারাদেশে ৫ হাজার ৫৬৯টি পদ সৃজনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই পদগুলো সৃজনের জন্য এখন কাজ শুরু হয়েছে। তার মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক পদ ৮টি, অতিরিক্ত পরিচালক ২৬টি, উপ-পরিচালক ৮৯টি, সহকারী পরিচালক বা সমমান ২১৯টি, সমাজসেবা অফিসার বা সমমান ৩১৪টি, ৬৪ জেলা কার্যালয়ে ২৭২টি, ৪৯২ উপজেলায় এক হাজার ৬৮২টিসহ সমাজসেবার হাসপাতাল, প্রবেশন অ্যান্ড আফটার কেয়ার সার্ভিস, আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শিশু পরিবারের জন্য ৫ হাজার ৫৬৯টি পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে পদ সৃজনের বিষয়ে গত ২৫ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, সমাজসেবার বেশিরভাগ দপ্তরেই জনবল নেই। যারা আছেন তাদের মধ্যে আবার যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। ১৯৮৪ সালের পর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কাজ অনেক বাড়লেও জনবল বাড়েনি। তাছাড়া এখানে কর্মরত কর্মকর্তাদের পদোন্নতিরও সুযোগ কম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদ সৃজনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। শিগগির আরো পদ সৃজনের প্রস্তাব পাঠানো হবে।
অন্যদিকে জনবল সংকটের বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ জানান, সেবাগ্রহীতাদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য পদ সৃজনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে যোগাযোগ করা হচ্ছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিবও আশ্বাস দিয়েছেন।