দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে করোনা ভাইরাস। পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশেই পৌছে গেছে এই ভাইরাস। এরপর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর থেকেই শুরু হয় ভ্যাকসিন প্রয়োগের তোড়জোড়। কারণ করোনার স্থায়ী সমাধান এই ভ্যাকসিনেই। দীর্ঘদিন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার পর তা খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোটি কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরেছে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এখন দেশে চলছে ব্যাপকহারে টিকা প্রয়োগ। আর সমস্যা হলো স্বাস্থ্যবিধি অবহেলিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এখন হাট-বাজার, ভ্রমণ স্পটসহ সর্বত্রই সেই আগের মতোই হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নূন্যতম আগ্রহও নেই কারো ভেতর। ফলে এখন যা চিত্র তা ঠেকাতে ভ্যাকসিনের সাথে সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। গত বছর এই সময়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেপথে হাঁটতে না চাইলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আবশ্যক। করোনার শুরু থেকেই স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বিশ^জুড়েই। এখনও তাই করা হচ্ছে। কিন্তু এই স্বাস্থ্যবিধি যাদের মেনে চলার কথা সেই সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা একেবারেই কমে গেছে। এখন তো প্রায় নেই বললেই চলে! অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। আমাদের অভ্যাসের একটি অংশ হওয়ার কথা ছিল স্বাস্থ্যবিধি। কিন্তু তা হয়নি। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি ততই মানুষের কাছে অবহেলিত হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস মানুষের মাঝে যে আতংকের সৃষ্টি করেছে তা থেকে মানুষ স্বাস্থ্যবিধিতে পাকাপাকিভাবে অভ্যস্থ হওয়ার কথা ছিল। যে অভ্যাস মানুষ পালন করতো করোনা ভাইরাস চলে গেলেও। যদিও করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমছে বিশ^জুড়েই, সেই সাথে স্বাস্থ্যবিধিও। বারবার বলা হচ্ছে যে ভ্যাকসিন গ্রহণ করলেও করোনার স্বাস্থ্যবিধি ঠিকঠাক মেনেই চলতে হবে, তা সত্ত্বেও এই অসচেতনতার পরিণতি আমাদের বিপদের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। করোনার প্রথম থেকেই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় ছিল সারা পৃথিবী। সেই প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছে। সারা বিশে^ কয়েকটি ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলছে। এসেছে এক ডোজের ভ্যাকসিনও। তবে সব কিছুর ওপরে সেই স্বাস্থ্যবিধি। বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, হাত বারবার সাবান দিয়ে পরিষ্কার করা, হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা বা সংস্পর্শে না আসা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে দেয়া, কাপড় চোপড়সহ সবকিছু জীবাণুমুক্ত রাখা ইত্যাদি সহ আরো বেশকিছু নিয়ম কানুন। এসব করার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা। সবসময়ের জন্যই এটা মেনে চলা প্রয়োজন ছিল।
এই সময়টাতে আমাদের সামাজিক দুরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মেনা চলা একান্ত প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি এমন একটি বিষয় যা আমাদের প্রতিদিন মেনে চলা উচিত। এটা ছোট থেকে বড় সবার মেনে চলা উচিত। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মতো নিত্য স্বাস্থ্যবিধি আমাদের এমনিতেই অনুসরণ করা উচিত। এর ফলে আমরা বহু রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারি। কিন্তু আমরা তা কতজন করি? নিজের সুরক্ষায় করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর প্রথম থেকেই এ কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু এখন হাট বাজারে সবর্ত্র পরিস্থিতি দেখে মনে হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তেমন কোনো আগ্রহ আমাদের মাঝে নেই। মাস্ক ব্যবহারেই চূড়ান্ত অনীহা দেখা যাচ্ছে। আইনের প্রয়োগ করেও মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করা যায়নি। অথচ এটার জন্য কোনো আইনের দরকার ছিল না। সবার নিজের থেকেই মাস্ক পরার উচিত ছিল। কারণ সুরক্ষা তো কেবল নিজের নয় বরং এর সাথে পরিবারের সুরক্ষাও জড়িয়ে রয়েছে। তবে আমাদের কারো ভেতর সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অবশ্য আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের উদাসীনতা বরাবরই নিজেদেরই দুর্ভোগের কারণ হয়েছে।
অর্থনীতিকে সচল রাখতে, জীবকার কল্যাণে মানুষ কাজে ফিরেছে। শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলিতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই সংক্রমণ ঠেকানোর কার্যকর পদ্ধতি। সেই ভরসা যারা বাস্তবায়ন করবে তারা সাধারণ জনগণ। একটু মেনে চললেই যখন দেশটাকে আরো সুন্দর করে তোলা যায় কিন্তু আমরা তা করতে নারাজ। আর করোনার সময়ে মেনে চলা আবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধি নিজের জীবনের প্রশ্ন। নিজের সাথে আরো অনেক মানুষের জীবনের প্রশ্ন। কারণ একজন থেকে অনেকে ছড়ায় এই ভাইরাস। অথচ সামান্য একটু অভ্যাস পরিবর্তন করলেই আমরা নিজেদের সুরক্ষিত করার পাশাপাশি অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখতে পারি। করোনা মহামারীর শুরুর পর থেকে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা,বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এসব স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এখনো তাই বলা হচ্ছে। কারণ এখনো প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আক্রান্তও হচ্ছে। এমনকি করোনা মহামারী বিদায় নিলেও এই অভ্যাসটা ধরে রাখা প্রয়োজন। যদি আমরা সবাই চাই তাহলে এই প্রাণহানি এবং আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারি আরও দ্রুত। এটা করা সম্ভব কেবল স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে অনুসরণ করলে। কিন্তু আমাদের সেই চিরাচরিত জীবন যাপন আমরা আজও ছাড়তে পারিনি। এই করোনার সময়েও আমরা প্রায়ই স্বাস্থ্যবিধি মানতে অস্বিকার করছি। করোনা শুরুর পর কিছুটা নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করলেও দিন গড়ানোর সাথে সাথে আমাদের মধ্যে থেকে সেই প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। যা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। এতে কোনোভাবেই ভালো হবে না। করোনা নিয়ন্ত্রণের যে প্রচেষ্টা তা সফল ভাবে সম্ভব হবে না। কারণ এর অনেকটা দায় আমাদের ওপরেও বর্তায়।
আমরা নিজেদের দায়িত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। রাস্তাঘাটে,গণপরিবহণে,হাট বাজারে মানুষের চলাচল দেখে বুঝতে কষ্ট হয় যে পৃথিবীতে করোনার অতিমারী চলছে এবং আমাদের দেশে এই অতিমারীতে প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। যার যার জায়গা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। যদিও আমাদের চিত্র প্রকৃতপক্ষে বিপরীত। সংক্রমণ উর্ধ¦মুখী হলেও সাস্থ্য সচেতনতা এখন একেবারেই নিন্মমুখী। মহামারীর পূর্বে আমরা যেভাবে চলেছি সেভাবেই চলতে শুরু করেছি। হয়তো করোনা ভাইরাসের বিষয়টিই আমরা ভুলতে বসেছি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এখনো দেশে করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে। ফলে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচল করা আমাদের নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য হুমকি হতে পারে। একটি প্রাণও তো মহামূল্যবান। একমাত্র সচেতনাই পারে এর থেকে রক্ষা করতে। আর উদাসীনতা পারে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে। আমাদের করোনার প্রতি এই গা ছাড়া ভাব থাকলে করোনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। অতিমারীর কথা স্মরণে নিয়ে আমাদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা উচিত। এটা নিজের, পরিবারের,সমাজের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট