বিশ^শান্তি দিবসে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিককর্মী হিসেবে বলতে পারি, দেশ-সমাজ-জাতির শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকৃত মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাস্তবতা হলো এই যে, ২০ বছর যুদ্ধের পর আমেরিকা ও ব্রিটিশ সৈন্যরা বলতে গেলে শূন্য হাতেই আফগানিস্তান ছেড়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী (ন্যাটো) আফগানিস্তানে হামলা চালায়। ওই সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক কোয়ালিশন আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আল কায়েদাকেও সাময়িকভাবে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স নামে একটি গবেষণা সংস্থার হিসাব মতে, ২০২০ সালেও বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে বিভিন্ন বিস্ফোরকের আঘাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেটসহ আরও অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সে দেশে নির্মূল হয়নি। ধর্মকে বিকৃত করে তালেবানরা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ফায়দা হাসিল করছে বলে অভিযোগ উঠলেও পপি-আফিম এবং অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের স্বার্থে রাশিয়ার মত পরাশক্তিও সমর্থন দিচ্ছে, সমর্থন দিচ্ছে বিধর্মী অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধান। কিন্তু বাস্তবতা হলো- একদিকে বিশ^ শান্তি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে শান্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে চলছে জাতিসংঘের ‘বিশ^শান্তি দিবস’ প্রক্রিয়া। অশান্তিতে ডুবে আছে স্বার্থের রোষানলে চলমান বিশ^; এখান থেকে মুক্তির পথ তৈরি করতে হবে বিশে^র সকল শান্তিকামি মানুষকে।
একথা সত্য যে, বিশ^ব্যাপী প্রচারিত তথ্য হলো- সশস্ত্র সংঘর্ষের অবসান যারা চায় জাতিসংঘ তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক আইন কাঠামো প্রণয়নের মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণের দ্বারা জাতিসংঘ ব্যবহার করে কুটনৈতিক নিবারক। জাতিসংঘ সহযোগিতা করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রায়ণে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে জাতিসংঘ যুদ্ধের নেপথ্য কারণ বা উৎসসমূহ নির্মূল করে এবং শান্তিকে সংরক্ষণ করার কৌশল বাস্তবায়ন করে। পাশাপাশি মানবিক সাহায্য, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন, জাতীয় অবকাঠামো মেরামত এবং পূর্ণগঠনে জাতিসংঘ সহযোগিতা করে এবং নির্মাণ করে শান্তির ছবি। জাতিসংঘ সনদের ঘোষণায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘ অর্ন্তভুক্ত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের জনগণ সম্মিলিতভাবে শান্তিতে বসবাস এবং আর্ন্তজাতিক শান্তি ও সংরক্ষণে তাদের সকল শক্তি-সামর্থ সমন্বিত করতে সংকল্পবদ্ধ। সনদে বিশ্ব শান্তি ও সংরক্ষণ এবং বিরোধ নিস্পত্তির প্রাথমিক দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের উপর অর্পিত। নিরাপত্তা পরিষদ মধ্যস্থতা, প্রভাব খাটনো ও নিস্পত্তি প্রয়াস, সামরিক পর্যবেক্ষক ও শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে এই দায়িত্ব সরাসরি পালন করে। জাতিসংঘ সনদের ১১ ধারা অনুযায়ী বিশ্ব শান্তির অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় আদর্শ বা নীতিমালায় সম্প্রসারণ করে সাধারণ পরিষদ। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব শান্তি রক্ষার প্রয়াস জোরদার করে তোলা, বিরোধ সমুহের শান্তিপূর্ণ নিস্পত্তি এবং আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছে বহু সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা। এইসব সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা কখনো ছিলো কার্যকর আবার কখনো বা অকার্যকর! কিন্তু জাতিসংঘ তাদের কাজের মাধ্যমে স্বীয় লক্ষ্যে পৌছাতে সবসময় তৎপর।
নতুন প্রজন্মের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিশ^পাঠের সূত্রতায় জেনেছি- ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের এক ঘোষণায় বলা হয়, স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিমালার প্রতি অশ্রদ্ধাই আর্ন্তজাতিক উত্তেজনা অব্যাহত থাকার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সিদ্ধান্তে নিন্দা করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের, আহ্বান জানানো হয়েছে। আগ্রাসনধর্মী তৎপরতা থেকে বিরত থাকার, বারবার প্রকাশ প্রকাশ করা হয় উত্তেজনার কারণ ও ফলাফল মুছে ফেলে বিশ্ব শান্তির রক্ষার ভূমিকা জোরদার করার। সংকল্প এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করে তোলার ভিত্তি ভূমি হলো বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সমতা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পারষ্পারিক নির্ভরতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জাতিসংঘের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে ১৯৮০ সালে ‘সান জোম্বে কোষ্টারিকায়’ শান্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। সেই সাথে বার্ষিক উদ্বোধনের দিনকে আর্ন্তজাতিক শান্তি দিবস ঘোষণা।
মানুষ সৃষ্টির জীব হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। মেধা ও মননের যৌথ সমন্বয়ের ফলে-ই এটি সম্ভব হয়েছে। একটি কথা অনম্বীকার্য যে জাতিসংঘের কাছে এমন কোন জাদুমন্ত্র নেই যা দিয়ে জাতিসংঘ শান্তির আবেশে ভরিয়ে দিতে পারে পৃথিবী। অথবা এমন কোন শক্তি নেই যা দিয়ে সে ছড়িয়ে দিতে পারে দেশে দেশে শান্তির সুবাতাস। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের কার্যকারিতা নির্ভর করে এর সদস্য ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সদচ্ছিার ওপর। জাতিসংঘের প্রয়াস সবাইকে নিয়ে একটি নিরাপদ সংঘাতমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলা। আমাদেরও প্রত্যাশা ‘বিশ্ব শান্তি দিবস’ মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে শান্তির দিকে ধাবিত হতে। বিশ্ব ধুঁকছে নানা রকম সমস্যায়। আছে খরা কিংবা অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আরো আছে সাইকোন-টর্নেডো কিংবা সুনামীর মতো প্রবল শক্তিধর দূর্যোগ। কিন্তু তারচেয়েও বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়গুলো। বিভিন্ন রকমের দূষণ ও দখল, কৃত্রিম দূর্ভিক্ষের ফলে নিদারুণ অনাহার মানুষের জীবনকে কঠিনতর করে তুলছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি করছে বিশ্বের আনাচে কানচে ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধ ও তাতে ব্যবহার করা অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংঘাত। সন্ত্রাসের কালো থাবায় প্রতি নিয়ত পিষ্ট হয়ে চলছে মানবতা। দুঃখের কথা হলো, এসব যুদ্ধে সৈনিকদের চেয়ে সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আবার তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে নিরপরাধ শিশুরা। বিশ^ শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পাশাপাশি সবার মনে রাখতে হবে- পবিত্র কোরআনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছে বাইবেল, ত্রিপিটক এমনকি গীতাও। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তা-ই বলব, যা আমার ভাই ইউসুফ (আ.) বলেছেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (নাসাঈ আল-কুবরা, হাদিস : ১১২৯৮)
বর্তমানে ধর্মের নামে যুদ্ধ করছে, যারা তালেবান-আইএসসহ বিভিন্ন নামে সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান পপি-আফিম বিক্রির টাকায় অস্ত্র কিনছে, মুসলমান হয়ে মুসলমানকে হত্যা করছে; তারাই শান্তির অন্যতম অন্তরায়। যারা ইসলামের নামে মানুষকে বোকা বানিয়ে এহসান গ্রুপের মত হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে তাদেরকে ‘না’ বলে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চলুন এগিয়ে যাই। মানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত থাকার কথা প্রতিটি পর্বে বললেও বাস্তবতা এই যে, জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব-ধর্ম-মানবতায় অন্ধকার ঢেলে দেয়ার কাজটি সবার আগে তারাই করেছে, যারা শান্তির কথা বলেছে, সমৃদ্ধির কথা বলেছে ঠিকই কাজ করেছে উল্টোটা। নিরন্ত্রীকরণ তৎপরতা, স্থল আইন নির্মূল অভিযান, বিভিন্ন দেশের সৈনিক, বেসামরিক পুলিশ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, মাইন পরিস্কারক, মানবাধিকার পর্যবেক্ষক, বেসামরিক প্রশাসন, ও যোগাযোগ বিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ সমন্বিত শান্তি রক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের আইনগত ও রাজনৈতিক পদক্ষেপসহ শান্তি প্রসারে একটি নিরাপদ পৃথিবীর জন্য জাতিসংঘের কার্যক্রম বিশাল ও ব্যপক। সফলতা ও ব্যর্থতার স্বাক্ষী হচ্ছে দীর্ঘ ইতিহাস।
যখন সারাবিশে^ সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-জঙ্গীবাদ-ধর্ম নিয়ে একের পর এক ধর্মান্ধদের হত্যাযজ্ঞ চলছে, শান্তির পরিবর্তে অশান্তির চাষাবাদে ব্যস্ত তথাকথিত ধর্মানুসারীরা; তখন বিশ^ব্যাপী বিশ^ শান্তি দিবস পালনের প্রস্তুতি চলছে। অথচ পৃথিবীময় সুন্দর ও মানবিক জীবন যাপনের জন্য মানসিক ‘শান্তি’ মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে অদৃশ্য ভাবে প্রেরণা যোগায়। বেঁচে থাকার অভিলাষে, একটু সুখ বা শান্তির সন্ধানে মানুষকে ছুটে বেড়াতে হয় চেনা-অচেনা কতো পথ! সম্মুখিন হতে হয় হরেক রকম পরিস্থিতির। আর হয়তো সে কারণে-ই সেপ্টেম্বর মাস আমাদের জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ মাস। কেননা এই সেপ্টেম্বর মাসেই মানবতার ব্রত নিয়ে জাতিসংঘ তাদের মহান যাত্রা শুরু করেছিলো। ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করে যে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তির জন্য উৎসর্গ করা এবং পালন করা উচিৎ ‘বিশ্ব শান্তি দিবস’ হিসেবে।
প্রত্যয় আর সাহস-সুন্দরের পথচলায় এই দিনটিতে সবাই একাগ্র হবে বিশ্বের দেশসমূহ ও মানুষের মধ্যে শান্তির আর্দশ প্রতিষ্ঠায় এবং সুদৃঢ় করণে। ১৯৯৮ সালের ৪ জুনে সাধারণ পরিষদ পুণরায় নিশ্চিত করে যে শান্তির জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত প্রয়াস স্মরণে প্রতি বছর পূর্বের ন্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক নিয়মিত অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনটি হবে বিশ্ব শান্তি দিবস। সেই শান্তি দিবস যেন নিমগ্ন মানবতায় অগ্রসর হয়, অবিরাম মানবতায় এগিয়ে চলে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি