বিশ্ব মহামারি করোনার ছোবলে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে থমকে থাকা শিক্ষা নগরী খ্যাত রাজশাহী আবারও তার চিরোচেনা রুপে ফিরছে। তবে এ চিরোচেনা রুপে ফেরার আনন্দের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। যে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীসহ নদী বা নৌকাভ্রমনকারি বিনোদনপ্রেমী। যারা প্রতিদিনই নদীতে নৌকায় চড়ে অনিরাপদভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে অথৈ পানি থাকায় এখন পদ্মার পুরোপুরি যৌবন। আর চলমান বাতাশের গতি মাঝে মাঝে বাড়ার সাথে সাথে যৌবনে ফেরা পদ্মার বুকে সৃষ্টি হচ্ছে বড় বড় ঢেউও। এরপর সেই ঢেউ খেলতে খেলতে ধাক্কা মারছে কুলে। যে ধাক্কায় ভাংছে পাড়। তার ভরা যৌবন গিলে খাচ্ছে তীরবর্তি বিভিন্ন স্থাপনাসহ জনবসতি। অথচ এই যৌবনে ফেরা পদ্মার বুকে ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন ভ্রমণ করছেন বিনোদনপ্রেমীরা। যে বিনোদনপ্রেমীর অধিকাংশই শিক্ষার্থী। করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষার্থীরা ছিল ঘরবন্দি। এখন প্রাণ ভরে দম নেওয়ার পাশাপাশি একান্তে প্রিয় বন্ধুর সাথে কথা বলার জন্য সেই আবেগি মন অনিরাপদভাবেই নৌকায় চড়ে যৌবনভরা পদ্মার ঢেউয়ের তালে তালে দৌল খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদের অধিকাংশদের মধ্যেই নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আর এই পদ্মার অনিরাপদ নৌ-ভ্রমণে একের পর এক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানীর একাধিক ঘটনা ঘটে থাকলেও নিরাপত্তার প্রশ্নটি আজও সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। পদ্মা তীরবর্তী ও রাজশাহীর স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে রাজশাহীর পদ্মায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত তিন বছরে রাজশাহীর পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৮ জনের। যে মৃত্যুর তালিকা থেকে বাদ রয়েছে পদ্মায় গোসল করতে গিয়ে অথৈ পানিতে তলিয়ে মারা যাওয়া তীরবর্তী ছাত্র হোস্টেল ও বসতিদের। মাঝিসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে বিনোদনপ্রেমী মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হতো।
তারপরেও ফায়ার সার্ভিস অফিসের এই তালিকা মতে, শখের বসে পদ্মায় নৌকায় ভ্রমণ করতে গিয়ে মারা গেছে ৫ জন। এদের মধ্যে দুইজন নবগঙ্গা এলাকায়, দুইজন টিবাঁধ এলাকায় ও একজন মুক্ত মঞ্চ এলাকায়। ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বরররা জানাচ্ছেন, পদ্মায় এই তিনটি পয়েন্ট ভরা মৌসুমে বিনোদন প্রেমীদের জন্য নৌকা ভ্রমন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ! এর পরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বিনোদনপ্রেমীরা এসব পয়েন্ট দিয়েই মাঝনদীতে চলাফেরা করছেন।
দুর্ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা হয়, মেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ^াস, কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিত স্বাভাবিক হয়ে যায়। এদিকে নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করার নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী উঠানোর অভিযোগও আছে। বর্তমানে প্রমত্তা পদ্মানদী এখন পানিতে টইটুম্বুর। তার মধ্যেই পাল্লা দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই চলছে ডিঙি নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত নৌ-যানগুলো।
পদ্মার টিবাঁধ, নবগঙ্গা, পদ্মা গার্ডেন ও মুক্ত মঞ্চ এলাকায় থাকা যাত্রী চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নৌ-ভ্রমণে লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক নৌকায় তা নেই। আর যাদের আছে তারাও লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করতে অনীহা প্রকাশ করে। যাত্রীদের অভিযোগ কিছু নৌকায় যে সকল লাইফ জ্যাকেট রয়েছে তা নোংরা ও দুগর্ন্ধ যুক্ত।
চালকরা জানাচ্ছেন, নৌকা ভ্রমনে যারা আসে, তারা ভালো কাপড় পড়েই আসে। তাই অনেকে লাইফ জ্যাকেট পরতে চায় না। তুবুও আমাদের পক্ষ থেকে বার বার অনুরোধ করি। তাই অনেকে না পরলেও হাতে ধরে রেখে দেয়। যে সকল নৌকায় লাইফ জ্যকেট নেই তাদেরও রাখার বিষয়ে বলা হয়।
রাজশাহী ফায়ার সার্ভিসের সাংশ্লিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, নৌ-যানে ক্রুটি, চালকের অদক্ষতা, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, নিরাপত্তা নির্দেশনা অমান্য করা, চলার পথে দুই নৌকার মধ্যে প্রতিযোগিতা, দুর্ঘটনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। গত বছর সর্বশেষ (২৫ সেপ্টেম্বর) পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। ওই দিন ১৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা নদীতে ডুবে যায়।
দুর্ঘটনায় ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) বিবিএ তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম সূচনা ও তার চাচাতো ভাই রিমন নিখোঁজ হন। ঘটনার সাতদিন পর পদ্মায় তাদের দু’জনের মরদেহ ভেসে ওঠে। পরে স্থানীয়রা ভাই-বোনের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশের কাছে দেন।
এছাড়াও নদীতে চলন্ত নৌকা থেকে যাত্রীদের পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছেই। গত ২০১৭ সালের মে মাসে মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে পদ্মায় ডুবে মারা যান পাঁচজন। এরপর ২০১৮ সালে প্রাণ হারান অন্তত দুইজন।
গত ২০১৯ সালে ১৫ জুলাই মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় চলন্ত নৌকা থেকে পড়ে যান দুই তরুণী। নৌকার কাঠের বেঞ্চসহ উল্টে পড়ে যান তারা। এরপর এই বেঞ্চটাকেই আকড়ে ধরে বেঁচে যান তারা। পদ্মায় বড় দুর্ঘটনা ঘটে গত বছরের ৬ মার্চ। মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় বর-কনেসহ ডুবে যায় দুটি নৌকা। এ ঘটনায় বিয়ের পরদিনই দুই শিশুসহ নয়জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল।
পদ্মার পাড়ে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা মোন্তাজুর রহমান জানান, অনেক নৌকাগুলোতে লাইফ জ্যাকেট নেই। থাকলেও যাত্রীর তুলনায় অনেক কম। আবার সেগুলো নোংরা ও ধুলোবালি লেগে আছে। ফলে লাইফ জ্যাকেট না পরেই নৌ-ভ্রমণ করছেন অনেকে। এতে করে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকছে।
মেহেদী হাসান নামের আরেকজন জানান, অনেক নৌকা বেশি যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী উঠায় নৌ-চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। লাইফ জ্যকেট পরার বিষয়ে বলা হলেও বেশিরভাগ মানুষ তা এড়িয়ে চলছেন।
রাজশাহী নৌ পুলিশের রেঞ্জের পরিদর্শক ওবাইদুল হক জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে পদ্মায় মোট ৩০টি নৌকায় জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিদিন আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রাজশাহী অঞ্চলের নৌ-পুলিশের এসপি দীন মোহাম্মদ জানান, নদীতে নৌকা ভ্রমণে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। এর আগে যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট না পরিয়ে নৌকায় ওঠানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান করছি। যাদের লাইফ জ্যকেট নেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।