তথ্য অধিকার দিবস সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ। সংবাদীয় শুভেচ্ছা অনলাইন প্রেস ইউনিটির পক্ষ থেকে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর মূল লক্ষ্য হল তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। জনগণ রাষ্ট্রের সব কর্তৃপক্ষের ওপর এই আইন প্রয়োগ করে। কর্তৃপক্ষের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এবং দুর্নীতি হ্রাসের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে সংবিধানে বর্ণিত অন্যতম মৌলিক অধিকার, চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে আইনটি প্রণীত হয়েছে। আইনের ৪ ধারা হল : Subject to the provisions of this Act, every citizen shall have the right to information from the authority, and the authority shall, on demand from a citizen, be bound to provide him with the information.Õ‘ঢাকাসহ সারা দেশে সাংবাদিকদের ডাকা সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে।’ এমন একটি শিরোনাম দেখে সংবাদের গভীরে গিয়ে জানতে পারি যে, তথ্যমন্ত্রীর কথায় পূর্বঘোষিত কর্মসূচি তারা স্থগিত করেছে। দেশে সাংবাদিক সমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষার কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য নিজস্ব স্বকিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মন্ত্রীর কথায় ওঠে বসে; সে দেশে তথ্য অধিকার দিবস কতটা উপকারে আসবে? এমন প্রশ্ন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে তৈরি করেছে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সত্যিকারের অবস্থান নিয়ে। তারা কি সত্যিকার্থেই সংবাদকে জনবান্ধব করছে, নাকি সরকার বা বিএনপিসহ তথাকথিত বড় দলবান্ধব করছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে দিনে রাতে চলতে চলতে যখন জেনেছি- ‘তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ইতিমধ্যে তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছেন। সরকারও দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট। তিনি এ বিষয়ে সহযোগিতার পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে কর্মসূচি স্থগিত রাখার জন্য সাংবাদিক নেতাদের অনুরোধ করেন। মন্ত্রীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত সমাবেশ কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন।’
বাংলাদেশে সাংবাদিক সমাজের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন, তাদের বিষয়ে এখন একের পর এক প্রশ্ন নির্মিত হচ্ছে। সম্প্রতি ৪টি সংগঠনের ১১ সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। যে প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব চাওয়া হয়েছে, তার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও সাংবাদিক নেতারা। ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। সাংবাদিক নেতারা নির্বাচিত শীর্ষ সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করার ক্ষেত্রে সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক পরিচয় একীভূত করার ঘটনাকে রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন, ঢালাওভাবে ব্যাংক হিসাব তলবের খবরে সারা দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার অন্ধকারের রাস্তায় এগিয়ে চলছে ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার আদায়ের পরিবর্তে লোভের রাস্তায় আমাদের কিছু সাংবাদিক। আর তাদের কারণেই তথ্য অধিকার দিবস কেবল দিবস হিসেবেই থেকে যাচ্ছে, প্রকৃত অর্থে এই দিবস থেকে যাচ্ছে অন্ধকারেই। এই দিবসের বিশদ জানতে চলুন জেনে নেই ইতিহাসে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার লক্ষ্যে জনগনের তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান, রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়ন, দুর্নীতি হ্রাসকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ মূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করা হয় "তথ্য অধিকার আইন ২০০৯"। এ আইনের ৪র্থ ধারায় তথ্য জানার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তথ্য ভিত্তিক ক্ষমতায়ণ ও সর্বক্ষেত্রে জনগণেন সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ২৮ শে সেপ্টেম্বর তথ্য জানার অধিকার দিবস পালিত হয়ে আসছে। যে দেশে তথ্য অধিকার দিবসের মাসে সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কথায় ওঠবসের প্রমাণ দিয়েছে, সেই দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্টার রোজিনা ইসলামকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়, তার ছবি এবং ভিডিও দেখে অনেকেই হতবাক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শত বছরের পুরনো অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট-এর অধীনে মামলা করা হয়েছে এবং তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি ফাঁস করে যে সব রিপোর্ট তিনি করেছেন, সেজন্যই রোজিনা ইসলাম-এর বিরুদ্ধে সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমরা জানি তখন রোজিনা ইসলাম এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো- তিনি অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রীয় নথির ছবি তুলেছেন। আমার প্রশ্ন হল, রাষ্ট্রীয় নথি প্রকাশ না করার জন্য তাকে কি সৌজন্যমূলক আচরণের মাধ্যমে বারণ করা যেতো না? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি প্রকাশ হওয়ার ভয়েই কি তার মুখ বন্ধ করার জন্য এমনটি করা হয়েছে? স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন ঘটনার অবসান হবে কবে? দুর্নীতি বা অনিয়ম ফাঁস করা যে জনস্বার্থে প্রয়োজন, তা নিয়ে কোন দ্বিমত থাকবে বলে আমার মনে হয় না মি. রহমান। কিন্তু এ'কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের গোপন সূত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়, গোপনে সরকারি দলিল-পত্র সংগ্রহ করতে হয়। এগুলো না থাকলে দুর্নীতি প্রমাণ করা কঠিন। এই তথ্য সংগ্রহের কাজ যদি অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সাংবাদিকতাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, যেটা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। বিরোধী দল শক্তিশালী না হওয়ায় সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, অত্যাচার এমনকি হত্যার মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। গণতন্ত্র আজ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে আমলাতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে।’ তথ্য অধিকার দিবসে সাহসের সাথে বলতে চাই অন্য অনেক সংবাদযোদ্ধা চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন কিছু প্রকৃত সংবাদযোদ্ধা। লোভ মোহের উর্দ্ধে থাকা সেই সংবাদযোদ্ধাদের তালিকায় রোজিনা ইসলাম রয়েছেন প্রথম সারিতে। তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার একটি বড় দিক হল, তাকে কোনও দুর্বৃত্ত কোনও অন্ধকার গলিতে আটকে রাখেনি বা তার গায়ে হাত তোলেনি। ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ে, দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে। আর তাকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করেছে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক। একটা প্রশ্ন কিন্তু তখন তৈরি হয়েছিলো, আর তা হলো- ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চেয়ে কি সংবাদযোদ্ধারা দূর্বল?’
উত্তর জানতে চলুন দেখে আসি সেই সময়ের ঘটনাপুঞ্জিতে ‘'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো "পাবলিক সার্ভিস মিনিস্ট্রি"তে কী এমন থাকতে পারে, যার জন্য মনে হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে? যেখানে অপরাধের কথাই ক্লিয়ার নয়, সে অপরাধের জন্য উনি তিন দিন কারাগারে আটক থাকলেন। এটাকে কি একটা বার্তা হিসেবে ধরে নেওয়া যায়? এত বড় একজন নামী সাংবাদিকের এরকম হেনস্তার পরে যদি কেউ সচিবালয়ে রিপোর্ট করতে যায়,তার মাথায় কি এই ঘটনা আসবে না, যে তারও এরকম হতে পারে? আমরা বিভিন্ন সময় দেখি, গণমাধ্যম কর্মীরাও বিভিন্ন সরকারি ইস্যু কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া, বসুন্ধরার কথাই ধরা যাক। তাহলে, আজকের রোজিনা ইসলামের এই অবস্থার জন্য গণমাধ্যম কর্মীরাও কোনো না কোনো ভাবে দায়ী নয় কি? তারা একতাবদ্ধ না হয়ে,দলীয়করণ করে ফেলছে বলেই, আজ এত সহজে এত বড় মাপের একজন সাংবাদিককে এরকম হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে না কি?’ আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পুরোপুরিভাবে জাতিসংঘের এজেন্ডা ২০৩০-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুযায়ী এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সংকল্পবদ্ধ। সব অভীষ্টের প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেই তথ্য অধিকার আইন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তন্মধ্যে ১৬.১০ লক্ষ্যমাত্রাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক- ‘জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী জনসাধারণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা ও মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষাদান।’ এ লক্ষ্যমাত্রার কর্মসম্পাদন পরিমাপকল্পে প্রস্তাবিত বৈশ্বিক সূচক (১৬.১০.২) হল ‘জনসাধারণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানিক এবং নিশ্চয়তামূলক নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নকারী দেশের সংখ্যা।
এত কিছুর পরও রাজনীতিকদের রোষানলে পড়তে যাচ্ছে আমাদের সাংবাদিক সমাজ। সেই সাংবাদিক সমাজেরই কেউ কেউ গত ১২ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে গুজব উঠেছে। কিন্তু তা কতটা সত্য তা জনগন জানে না। তবে এতটুকু তারা জেনেছে যে, অস্বাভাবিক লেনদেনের কারণে ১১ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসেব তলব করেছে সরকার। কিন্তু তা যেন এমন না হয়ে যায় দুর্নীতির অর্থে দেশের বাইরে একের পর এক টাকা পাচারের খেলা খেলে যাচ্ছে রাঘব বোয়ালরা, নাম পড়ছে চুনোপূঁটিদের। তার উপর আবার সাংবাদিকদেরকে কোন সহায়তা না দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা বলছে যে, ২১০ টি সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু তথ্য অধিকার দিবসে সংবাদপত্র ও সংবাদযোদ্ধাদের অধিকার আদায়ের রাষ্ট্র হলে সংবাদপত্রের সম্পাদকদেরকে অর্থনৈতিক সহায়তা অথবা প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করতো। অবাধ-সুষ্ঠু সংবাদ প্রবাহ নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে সংবাদপত্র সক্রিয় রাখতো, বন্ধ করতে উদ্যেগ গ্রহণ করতো না। খোঁজ নিতো যে কি কারণে ডিক্লারেশন নেয়ার পরও কেন পত্রিকাগুলো চালাতে পারছে না, চিহ্নিত করে তাদের পাশে দাঁড়াতো। তা না করে পত্রিকা বন্ধ করার এই সিদ্ধান্ত তথ্য অধিকার দিবসে সবচেয়ে বড় আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। তথ্য অধিকার দিবসে সংবাদযোদ্ধা ও সংবাদপত্রের সাথে পথচলার ২৫ বছরের পথিক হিসেবে বলতে চাই- যদি দেশকে সত্যি ভালোবাসেন, মানুষকে ভালোবাসেন, তাহলে সংবাদপত্র বন্ধ নয়; তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিন, পাশাপাশি সহায়তা করুন নিউজ পোর্টাল-এর উদ্যেক্তা সংবাদযোদ্ধাদেরকে। যাদের হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ-স্বাধীনতা-স্বাধীকার আর অধিকার আদায়ের স্বপ্ন। একইভাবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধাপরাধী-দুর্নীতিবাজ-জঙ্গী নিয়ন্ত্রিত নিউজ পোর্টালগুলোকে চিহ্নিত করুন-বন্ধ করুন। তবে বাংলাদেশের মাটি-মানুষের জন্য নিবেদিত থাকা প্রতিটি সংবাদমাধ্যমকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন নিরন্তর...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি ও প্রতিষ্ঠাতা, অনলাইন প্রেস ইউনিটি