মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদের মালিকানায় ডাক অধিদপ্তরকে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফলে ডাক অধিদপ্তর নগদের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক হবে। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার থাকবে নগদ লিমিটেডের হাতে। তবে নগদের কোন ঋণের দায়ভার নেবে না ডাক অধিদপ্তর।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ মঙ্গলবার নগদের মালিকানা নির্ধারণের বিষয়ে সভা করেছে। এই সভায় ডাক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (রেজেসকো) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আগের মতো এই সভাতেও সিদ্ধান্ত হয় যে নগদ পরিচালনায় নতুন করে ‘নগদ বাংলাদেশ পিএলসি’ নামে পৃথক কোম্পানি গঠন করা হবে। এর মালিকানার ৫১ শতাংশ আসবে ডাক অধিদপ্তরের অধীনে আর ৪৯ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে থাকবে। এজন্য আলাদা যে কোম্পানি হবে, সেটির পরিচালনা পর্ষদ হবে ৯ সদস্যের। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ ৫ জন হবেন সরকারের প্রতিনিধি, বাকি ৪ জন বেসরকারি খাতের।
সভায় জানানো হয়, নগদ বাংলাদেশ পিএলসি গঠন বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছিল। তবে এখনো সবাই মতামত পাঠায়নি। তাই পরবর্তী সভায় এ নিয়ে আবার আলোচনা হবে।
সভায় ডাক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা নিতে তারা অর্থ দেবে না। নগদ এতদিন ডাক অধিদপ্তরের যে ব্র্যান্ড ব্যবহার করেছে, তার দাম প্রতিষ্ঠানটির ৫১ শতাংশের সমপরিমাণ বলে গণ্য হবে। নগদের যে ব্যাংকঋণ রয়েছে ও বন্ড ছেড়ে টাকা তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার কোনো দায়ও ডাক অধিদপ্তর নেবে না।
এদিকে নগদের ঋণের পরিমাণ ঠিক কত - সেটা বলতে রাজি নয় নগদের কর্তৃপক্ষ।
নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদের ভাষ্য, আমরা লিমিটেড কোম্পানি। একটা প্রাইভেট কোম্পানি যেভাবে লোন নেয়, সেভাবে লোন নিয়েছে এবং তা পরিশোধ হচ্ছে। এটা নিয়মিত বিষয় হলেও এনিয়ে গুজব ছাড়ানো হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এনিয়ে কোম্পানি গঠনে জটিলতার কিছু নেই।
তবে নগদ নিয়ে সম্প্রতি বেশ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। জানা যায়, আড়াই বছরে দফায় দফায় একাধিকবার মালিকানায় পরিবর্তন হয়েছে নগদের। নগদের মালিকানা রদবদলের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। শুধু তাই নয়, এর টাকার বেশি অংশ পাচারও হয়েছে। পাচারকারীরা তা বিদেশেও বিনিয়োগ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বারবার মালিকানা পরিবর্তনের নামে নগদ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একপ্রকার কৌশল বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এটা নগদ নয়, যেন টাকশাল। নগদকে টাকশাল বানিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে শত কোটি কোটি টাকা। এখন নগদের পরিচালক ৯ জন, যারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের একজন করে নাগরিক রয়েছেন। অন্য ছয়জন বাংলাদেশি।
অভিযোগ উঠে, রাষ্ট্রের ডাক বিভাগের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে নগদ। গত মাসের মাঝামাঝিতে ‘নগদ’র সঙ্গে ডাক বিভাগের অংশীদারিত্বের বিষয়ে একটি কুচক্রী মহলের চলমান বিভ্রান্তিমূলক প্রচারকে উড়িয়ে দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. আফজাল হোসেন বলেছেন, ‘নগদ’ প্রধানমন্ত্রী স্বীকৃত একটি আর্থিক সেবা। এই মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে ডাক বিভাগ তথা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অংশীদারিত্ব রয়েছে, এটা সর্বজন স্বীকৃত। এটি সবাই জানে যে, প্রধানমন্ত্রী ‘নগদ’র এই সেবাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তিনি নিজে ১০ হাজার টাকা দিয়ে এটির লেনদেন শুরু করেন। কাজেই এই ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি রয়েছে।’
সচিবের আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সিরাজ উদ্দিনও পৃথক পৃথক বার্তায় ‘নগদ’র মালিকানা নিয়ে অপপ্রচারকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘নগদ’ ডাক বিভাগের সেবা, এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।
কোম্পানী আইনে প্রাকটিস করেন, এমন একজন আইনজীবী ফাউজিয়া করিম মনে করেন, অর্থ লেনদেনের ব্যাপারে সরকারি বিভাগের কোম্পানি গঠনের মত গুরুত্ব ইস্যুতে সংসদে উত্থাপন করা উচিত ছিল।
এদিকে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, এখন প্রচলিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে কোম্পানি গঠন করা যাবে নাকি নতুন আইন করতে হবে-এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হবে।
তিনি দাবি করেছেন, ছয় মাসের মধ্যেই নগদের মালিকানা নিয়ে কোম্পানি গঠনের চেষ্টা তারা করছেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নগদের মালিকানা ডাক অধিদপ্তরের হাতে যাওয়ার পর লাইসেন্স দেওয়া হবে। তবে এজন্য নগদকে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বা এমএফএস হিসেবে অনুমোদন পেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া কিছু শর্ত পালন করতে হবে।
ডাক অধিদপ্তরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো, নগদ গ্রাহকের জমা টাকার বিপরীতে যে ঋণ নিয়েছে, তা সমন্বয় করতে হবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকের টাকার বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর একটা অংশ শোধ করার পর ঋণের পরিমাণ এখন আছে ৩২৮ কোটি টাকা।
নানা জটিলতায় ঝুঁকিতে আছেন নগদের রেজিস্ট্রিকৃত ৩ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহক। দৈনিক মোট লেনদেন ৪০০ কোটি টাকা হওয়ায় নগদের বর্তমান মূল্য এখন ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি কোনো নির্দেশনা ছাড়াই নগদ কর্তৃপক্ষ কয়েক হাজার গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। কোন উদ্দেশ্যে, তা আদৌ স্পষ্ট নয়। কয়েক দিনে কিছুসংখ্যক ‘নগদ’ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে হঠাৎ করে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্বাভাবিক লেনদেন হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর পর্যালোচনা ও লেনদেনের ধরন পরীক্ষা করে কিছু অ্যাকাউন্ট সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলোর তালিকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কাছে হস্তান্তর করে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’। তবে আশার কথা হচ্ছে হোল্ড হয়ে যাওয়া ১০ হাজার অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছে।
নগদ লিমিটেড এতদিন যে অবৈধ বাণিজ্য করছে, তার লাগাম টেনে ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংক উঠেপড়ে লেগেছে। দিয়েছে নানা শর্তও। এখন থেকে অনুমতি ছাড়া ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে না ‘নগদ’। সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’র ই-মানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ‘নগদ লিমিটেড’ নামীয় প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট না খোলার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলো। জানা যায়, ডাক বিভাগের ‘নগদ’ এতদিন পরিচালনা করত থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড। এখন থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড নাম পরিবর্তন করে ‘নগদ লিমিটেড’ করা হয়েছে। এটি ডাক বিভাগের সেবা বলা হলেও এতদিন মালিকানায় ডাক অধিদপ্তরে কোনো অংশ ছিল না।
উল্লেখ্য, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডাক অধিদপ্তরের সাথে একটি চুক্তি করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনুমতি নিয়েছিল ২০১৭ সালে। সেই চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠাটির সাথে ডাক বিভাগের মুনাফা ভাগাভাগি হয়েছে।