সম্প্রতি করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কমায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে স্কুল ও কলেজপর্যায়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেকটাই কম। দুই-একটি স্কুলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে সংক্রমণেরও খবর পাওয়া গেছে। এ খবর উদ্বেগজনক। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখবার উপায় নেই। পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী করোনা সংক্রমণের আগে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিল ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে। বর্তমানে সেটি ৫৬ শতাংশে নেমে আসা উদ্বেগজনক। তবে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, উপস্থিতির হার কমে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে এসব শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর করোনা উপসর্গ ধরা পড়ায় অনেক মা-বাবা সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। তাই একে স্থায়ী সমস্যা ভাবা ঠিক হবে না। একজন শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উপস্থিতি কম হলেও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৯৩ শতাংশ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে।
তাই বলে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয়। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ১২ সেপ্টেম্বর এসেও পরে অনুপস্থিত থেকেছে, তাদের অনাগ্রহের কারণটি খুঁজে বের করতে হবে। অনেক অভিভাবক বলছেন, সপ্তাহে এক দিন ক্লাস হওয়ার কারণে তাঁরা শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না। এ সমস্যা সমাধানে শ্রেণিকক্ষে পাঠের সময় বাড়াতে হবে। করোনা সংক্রমণের হার কমতির দিকে। ফলে যেসব অভিভাবক এখনো ভয়ভীতিতে আছেন, তাঁরা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠাবেন আশা করি। যেসব ছেলেশিক্ষার্থী পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য কাজে যেতে বাধ্য হয়েছে, তাদের আউট অব এডুকেশন প্রোগ্রামে (পিইডিপি-৪) যুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। যেসব মেয়েশিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে, তারা যাতে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে, সে বিষয়েও কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে বিয়ের পরও মেয়েদের পড়াশোনা চালানোর অসংখ্য উদাহরণ আছে।
শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শুরু হয় বাড়িতে বা পরিবারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক তাঁর নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অর্জিত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলেন শিক্ষার্থীদের। এ শিক্ষাদান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষাকে ফলপ্রসূ ও কল্যাণপ্রদ করে তুলতে ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক অপরিহার্য। সুদূর অতীত থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুন্দর এবং অকৃত্রিম সম্পর্কের বন্ধন ছিল। এখনও তা পুরোপুরি উবে যায়নি। শিক্ষার্থী শিক্ষককে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। শিক্ষকও শিক্ষার্থীকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। শিক্ষক প্রয়োজন হলে শিক্ষার্থীর প্রতি অভিভাবকসুলভ কঠোরতা ও শাসন আরোপ করতেন। পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের খোঁজখবর রাখতেন। কোনও শিক্ষার্থী স্কুলে না এলে কিংবা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থীর বাড়ি গিয়ে পরামর্শ ও উৎসাহ দিতেন। খোঁজখবর নিতেন। দিকনির্দেশনা দিতেন। কিন্তু সেদিন এখন আর নেই। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার সেসুমধুর সম্পর্ক এখনকার বাস্তবতায় কেবলই পেশাভিত্তিক হয়ে পড়েছে। কোনও শিক্ষার্থী স্কুলে না আসলে কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে তা শুধু রেজিস্টারেই লিপিবদ্ধ থাকে।
শিক্ষকতা একটি মহানুভব পেশা। দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা মানবিকতার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্ব পালন করবেন এবং অতীতের ন্যায় পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলবেন এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। এ ছাড়া করোনাপরবর্তী স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলা কঠিনই মনে হয়। কাজেই, সরকার এ বিষয়টি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেÑএটাই কাম্য।