পানি সম্পদ বা জল সম্পদ হল পানির সেই সমস্ত উৎসসমূহ যেগুলি মানুষের নিয়মিত ব্যবহারের জন্য অতিপ্রয়োজনীয়। কৃষি, শিল্প, গার্হস্থ্য ব্যবহার এবং পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণসহ মনুষ্যজীবনের সর্বক্ষেত্রেই পানির ব্যবহার অপরিহার্য। এবং এইসকল কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেটি অত্যাবশ্যক সেটি হল পরিশোধিত বিশুদ্ধ পানি। পৃথিবীতে লভ্য পানির প্রায় ৯৭.৫% হল লবণাক্ত এবং বাকি মাত্র ২.৫% বিশুদ্ধ। এই স্বল্পপরিমাণ শুদ্ধ পানির আবার দুই-তৃতীয়াংশই কঠিন অবস্থায় অর্থাৎ তুষার, হিমশৈল, ইত্যাদি রূপে বিদ্যমান। অবশিষ্ট তরল পানির অধিকাংশই ভূগর্ভস্থ এবং অতি অল্পপরিমাণ পানি ভূপৃষ্ঠস্থ জলাশয়ে লভ্য।
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি হলেও মিঠা পানির পরিমাণ খুবই কম। তাই পানি সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীতে প্রাপ্ত মিষ্টি পানির প্রায় ৭০ ভাগই ফসল উৎপাদনে কৃষকরা ব্যবহার করেন। শিল্প-কলকারখানা ব্যবহার করা হয় ২০ ভাগ এবং ১০ ভাগ ব্যবহার করা হয় গৃহস্থলীর কাজে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বয়ে চলেছে হাজারো ছোট-বড় নদী। কেউ বলে নদ-নদী বাংলাদেশের হৃদপিন্ড। কেউ বা বলে ফুসফুস। যে যাই বলুক, নদ-নদীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নাই। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই দেশ নদ-নদী বিধৌত পলিমাটি দিয়ে হয়েছে উর্বর, ফুল ফল আর ফসলে করেছে সমৃদ্ধ। নদী গ্রামীণ জনপদ কর্মচঞ্চল রাখতে একদিকে যেমন অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে, তেমনি গতিময় শহুরে জীবনকে আরও বেগবান করতে ভুমিকা রাখে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে অপরিশোধিত ও পয়ঃবর্জ্য ফেলে ভয়াবহ পানি দূষণ করা হচ্ছে। গত এক যুগে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছস প্রভৃতি কারণে দেশের স¤পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে পানি স¤পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরী। পানি সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ এবং বছরব্যাপী বহমানতা বজায় রাখতে পারলে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণতা শুধু নয় বিপুল পরিমানের খাদ্য উৎপাদন উদ্বৃত্ত রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ও নিষ্কাশন, নদী তীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ, ব-দ্বীপ উন্নয়ন, ভূমি পুনরুদ্ধার প্রভৃতি বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যারেজ, রেগুলেটর, খাল, বেড়িবাঁধ, রাবার ড্যাম, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন-পুনঃখনন করে সেচ, জলাবদ্ধতা নিরসন, বন্যা প্রতিরোধ, নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ, ভূমি পুনরুদ্ধার সেবাসমূহ প্রদান করে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রধান সংস্থা যা পানি সম্পদ উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং ৫৯ তদানিন্তন ইপি ওয়াপদা ‘পানি উইং’ নিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা সৃষ্টি করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পানির সংকট দূর করার ব্যাপারে কার্যকরি অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কিন্তু দেশে পরিমাণ ও গুণগতভাবে পানির সঙ্কট এখনও বিদ্যমান। বাংলাদেশ এখনো আর্সেনিকমুক্ত হতে পারেনি। বন্যার জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে বন্যা অববাহিকা অঞ্চলে যে পানি শাসন প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়, তা বিভিন্নভাবে প্রাকৃতি পানিপ্রবাহের ভারসাম্যের জন্য নেতিবাচক রূপে প্রত্যাবর্তন করছে। বর্ষা মৌসুমে একাধারে বন্যার কারণে যেমন নদী অববাহিকা অঞ্চলগুলো পলিসমৃদ্ধ হচ্ছে, তেমনি অনেক নদী অববাহিকা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য চাই উন্নত ও সুবিবেচিত পানি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। এজন্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা হতে হবে সমন্বিত, সুসংহত ও বিজ্ঞানসম্মত। সরকার এ ক্ষেত্রে কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে এটাই কাম্য।