হঠাৎ কয়েক দিনের মুশলধারের বৃষ্টিতে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে ভবদহ পাড়ের মানুষের জীবন-যাপন। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে চরমে। কেউ মারা গেলেও দাফন-সৎকারের সমস্যা তো রয়েছেই গেছে। গবাদিপশু যা দু’একটি রয়েছে তা নিয়ে সমস্যার মধ্যে দিন কাটছে তাদের। এছাড়াও প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা উজানের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ভুক্তভোগী মানুষের মাঝে আরও বেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অভিশপ্ত ভবদহে স্থায়ী সমস্যার কারণে প্রায় চারদশক ধরে জলাবদ্ধতার শিকার মণিরামপুর-কেশবপুর, খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা থানার ৮০টি গ্রামের বাসিন্দারা। এ চারটি উপজেলার ৮০টি গ্রামের লক্ষাধিক পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে জীবন-যাপন করছেন। ভবদহ এলাকা সংলগ্ন প্রায় সবকটি বিল ছাপিয়ে পানিতে বসতবাড়ি স্থায়ী ভাবে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এসব অঞ্চলে কোন কোন পরিবার বাড়িতে পানিবন্দি অবস্থায় থাকলেও খোঁজ খবর নিচ্ছেন না কেউ। এ রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত পানিবন্দি এলাকায় ত্রাণ সামগ্রীসহ কোন ধরনের সাহায্য পৌছায়নি বলে অভিযোগ করেছেন রাস্তার উপর খুপড়ি ঘর বেঁধে থাকা হাটগাছা গ্রামের ঠাকুর দাস মন্ডল।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির মশিয়াহাটি আঞ্চলিক কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষক উৎপল বিশ্বাস বলেন, হঠাৎ করে আকাশ বৃষ্টি হওয়ায় এলাকায় পানি আরো বেড়ে গেছে। মানুষ খাদ্য চিকিৎসা এবং বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন। এসব ব্যাপারে সরকারী-বেসরকারী কোন উদ্যোক্তাই পানিবন্দি মানুষগুলোর খোঁজ খবর নিচ্ছেননা। অনেকেই বাড়িÑঘর ছেড়ে রাস্তা অথবা উঁচু কোন স্থানে খপড়িঘর বেঁধে কোন রকম মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। মানুষ মারা গেলে দাফন করার জায়গা মিলছে না। অনেক মৃত্যু ব্যক্তির দাফন করতে দূরের কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এদিকে উপজেলার কুলটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা আ¤্রঝুটা গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী রোকেয়া বেগম মঙ্গলবার সকালে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করলে তাকে দাফন এবং সৎকার করতে মহা বিপাকে পড়েন তারা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। মৃত্যুর সময় তিনি স্বামী, ৪ ছেলে, ৩ মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। এলাকায় পানিতে তলিয়ে থাকায় নিজ পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করতে পারেননি। খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে, মৃত রোকেয়া বেগমকে দাফন করতে অন্যত্র নেওয়া হয়েছে।
মরহুমের ছোট ছেলে কুলটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও যশোর আবদুর রাজ্জাক কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক আবদুল কুদ্দুস বলেন, আমার বসতবাড়ি এবং কবরস্থান পানিতে প্লাবিত থাকায় মৃত. মাকে সৎকার করতে চরম হিমশিম খেতে হয়েছে। বাড়ির উঠানে হাঁটু পানি থাকায় আমার নির্মাণধীণ বিল্ডিংয়ের ঘরে মৃত. মায়ের গোসল করিয়েছি। এ ছাড়া নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে মাঝাপানি জমে থাকায় গোষ্টির (শরীকদের) সাবেক কবরস্থানে মায়ের দাফন কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। তিনি অত্যান্ত ক্ষোভের সাথে আরও বলেন, আজ নিজের মা’কে নিজস্ব কবরস্থানে না রাখতে পেরে এবং সুষ্ঠ পরিবেশে কাপন-দাফন না করতে পারায় আমাদের পরিবারের মাঝে নিদারুন একটা ঝড় বয়ে গেলো।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব চৈতন্য পাল বলেন, ভবদহের সমস্যার কারণে মানুষ যে অবস্থায় ছিলো, হঠাৎ ক’দিনের বৃষ্টিতে জল বেড়ে যাওয়ায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। এই মুহুর্তে আমডাঙ্গা খাল ¯্রােত ধারা সৃষ্টির জন্য যা করনীয় তাই করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সংগঠনটি। মঙ্গলবার ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি মশিয়াহাটি হাই স্কুলের এক মিটিং করা হয়।
পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালী বলেন, এই মুহুর্তে ভবদহ অঞ্চলের মানুষ বাঁচাতে ভবদহের ২১ ভেল্টের কপাট খুলে দেওয়ার বিকল্প কিছুই ভাবছি না। এ ছাড়া আমডাঙ্গা খাল জল ধারা তৈরী করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। ওই অঞ্চলের স্থায়ী জলাবদ্ধতার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করে রনজিত বাওয়ালী আরও বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ভবদহের সমস্যাকে জিয়ে রেখে ব্যবসা বাণিজ্য করে চলেছেন। এর সাথে এলাকার কিছু নামধারী নেতা ও জনপ্রতিনিধি জড়িত রয়েছে।
যে কারণে ভবদহের সমস্যার স্থায়ী সমাধান আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে শংকায় রয়েছে ভূক্তভোগী জনসাধারণ। এ সংগঠনের নেতারা এলাকার সমস্যার সমাধানের জন্য দ্রুত টিআরএম চালু, আমডাঙ্গা খাল খনন এবং শ্রী-হরি নদীর স্লুইচগেটের দক্ষিণ অংশের পলি অপসারণের দাবী জানিয়েছেন।
এসব বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করা হলে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এ মুহুর্তে ২১ ভেল্টের মধ্য থেকে কয়েকটি ভেল্টের কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দ্রুত পানি সরানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।