আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। আমাদের মধ্যে মায়া,মমতা,আবেগ,কান্না,হাসি,দুঃখ,কষ্ট সব আছে। অন্যকে ছোট করার প্রবণতা আছে, কাউকে ঠকানোর পর আনন্দ করার অমানুষিকতাও আছে! আমরাই আবার বকশিশ কম হওয়ায় মৃত্যুপথযাত্রী একজন রোগীর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেই। তারপর আমরা নিজেদের মানুষ বলে গর্ব করি! কারণ এতকিছুর পরেও আমরা মানুষ। আমাদের জ্ঞান আছে আবার অজ্ঞানতাও আছে। ক্ষমতার লোভ আছে, প্রতিবাদও আছে। আবার চোখের সামনে কাউকে মরতে দেখলে চুপ করে থাকার প্রবণতাও আছে! তবুও আমরা মানুষ বলে দাবী করতে পারি! কারণ এমন বৈশিষ্ট্যের আর কোনো প্রাণী এখনও মহাবিশে^ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই সভ্যতার যাত্রা সামনের দিকে ধাবমান। সময়ের চাকায় পেছনে যাবার সুযোগ নেই। তাই আমরা এগিয়ে চলেছি। তাই সামনের দিকে অন্তহীন যাত্রায় এগিয়ে চলেছে এ মানব সভ্যতা। আমাদের কর্মে ও মননে প্রতি পদক্ষেপে মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সৃষ্টির অন্য প্রাণী থেকে মানুষ শ্রেষ্ঠ এটা তার কর্ম দিয়েই প্রমাণ করেছে। সভ্যতা বিকাশের পথে মানুষের ভেতর হিংসা,ক্রোধ,লোভ-লালসাও বিকশিত হতে লাগলো। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে উঠলো। বহু সভ্যতা মানুষের দুষ্কর্মে ধ্বংস হয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন কোনো সভ্যতা। চাপা পরেছে সেই সব উন্নত সভ্যতার সব নিদর্শন। এভাবে মানব সভ্যতা বিকশিত হতে হতে আজকের এই আধুনিক বা অতি আধুনিক সভ্যতায় এসে উপনীত হয়েছে। এই সমাজকে সভ্য সমাজ বলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সভ্য সমাজ প্রকৃতপক্ষে কতটা সভ্য হতে পেরেছে। আদিম যুগে পশুদের সাথে বসবাস করতে করতে সভ্য হতে বহু বছর সময় নিয়েছে। আজ পশুরা বনে আর মানুষ শহরে। তবে মানুষ কিন্তু পশুত্বকে দমন করতে পারেনি। মনের ভেতর পশুটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের প্রতিদিনকার কর্মকান্ড,আদব-কায়দা,আচার-আচরণ প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে বিচার করা উচিত এই সভ্যতা, এই সমাজ সত্যিকার অর্থে সভ্য কি-না। আমাদের কর্মকান্ড সেই বর্বর ও অসভ্য সময়েই ইঙ্গিত বহন করে চলেছে। মিথ্যেই নিজেদের সভ্য বলে গলা উঁচু করে কথা বলা।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়,টেলিভিশনের খবরে সমাজের অস্থির চিত্র দেখি। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। মনের বোধের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো অনুভূতি হয় না। মনটা অজানা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিছুই করার থাকে না। সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই যাত্রা তো ফের উল্টোদিকে টানছে না আমাদের। পশুর সাথে বসবাস করতে করতে পশুর আচরণ বেশ রপ্ত করতে পেরেছে মানুষ জাতি। পশুর মতোই হিং¯্রতা, পশুর মতোই লোভ,আপন-পর,ছোট-বড় বোধশূণ্য। সময়ের উল্টোযাত্রায় আজ আমরা সবাই শামিল হয়েছি। অল্প ক’জন ভালো মানুষ এ সমাজে আজ বড় বেকায়দায়। তারা এই আড়ম্বরপূর্ণ সমাজ নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। বিপরীতে যারা অন্যের কাঁধে ভর করে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পকেট মোটা করে বসে আছে তারাই সমাজের হর্তাকর্তা। তাদের মুখের কথাই আইন। তাদের কথায় সবাই ওঠবস করে। তাদের দেখলে রাস্তাঘাটে সালামের হিড়িক লেগে যায়। কেউ ভয়ে আবার কেউ তোষামদ করে চলছে প্রতিনিয়ত। তেল দেয়াই যে এ সমাজের ওপরে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। যে যত দক্ষ হাতে তেল দিতে পারবে সে তত ওপরে উঠতে পারবে। তারপর একদিন তাকেও তেল দেয়া শুরু হবে। এই তেলে কোনো ভেজাল নেই। এরা কিছু না বুঝলেও সব বোঝেন, কিছু না করলেও ফরমাশ দিতে ওস্তাদ, তারাই সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তা। এসব কর্তার চোটপাটে বাকিরা ভর্তা হবার যোগাড় সেদিকে কারো লক্ষ নেই! এরাই আজ সভ্যতার অগ্রগতি মাপার বড় মাপকাঠি।
যে সমাজে সবাই সবাইকে ঠকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকি, দুহাত পেতে বাইরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কর্মক্ষম মানুষ হাত পেতে ভিক্ষা করতে সম্মানবোধ করে আর ভেতরে সুট্যেড-বুট্যেড মানুষেরা ঘুষ নামক ভিক্ষা নিয়ে জীবনধারণ করে, মানুষ মানুষকে মারার জন্য নিত্য নতুন অস্ত্র তৈরি করে, ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে প্রতিনিয়ত রেষারেষি, শিক্ষার নাম করে বাণিজ্যের দুয়ার খুলে বসে থাকে,আতংক আর অস্থিরতায় সময় পার করতে হয় সে সমাজকে কেবল বড় বড় দালানাকোঠা,ব্যবসা বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির মাণদন্ডে আধুনিক সভ্য সমাজ বলা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। সমাজের উৎকর্ষ সাধন কেবল পোশাকে-আশাকে হয়েছে, মননে-মানবিকতায় হয়নি। সভ্যতা এগিয়েছে কিন্তু মানসিকতা পিছিয়েছে। সভ্যতার শুরুতে মানুষের পোশাক ছিল না। লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের বাকল ব্যবহার করতো। এখন বাহ্যিক লজ্জা নিবারণের জন্য স্যুট ব্যুট আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু চক্ষু লজ্জা প্রায় নেই বললেই চলে। এখন ইচ্ছা করলেই মিথ্যা বলা যায়, কারো সাথে প্রতারণা করা যায়, কাউকে মঞ্চে দাড়িয়ে মিথ্যা আশ^াসের বাণি শোনানো যায়। এ লজ্জা ঢাকার কোনো পোশাক নেই। এদেশে একটা বালিশ কিনতে হাজার হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়, কেরানীর চাকরি করে বড় বড় বাড়ি গাড়ির মালিক হওয়া যায়। অন্য চিত্রও আছে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে পান্তা ভাত দিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করা মানুষগুলোও এ সভ্যতারই মানুষ। ভদ্র পোশাক পরা মানুষগুলো যারা সভ্যতার দোহাই দিয়ে অবলীলায় অসভ্য কার্যক্রম করে যাচ্ছে তাদের ভেতর থেকে আজও সেই আদিমতা ধুয়ে মুছে যায় নি। মনুষ্যত্বের কোনো বিচারেই এদের মানুষ বলা ঠিক হবে না।
এভাবে একটি মানুষ বিহীন সমাজ গড়ে তুলতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়! আমরা যতই উৎকর্ষ লাভ করছি ততই পেছনের দিকে যাচ্ছি। যেখানে মানুষ হয়েও মানুষের কোনো দায় নেই। সামান্য টাকা বকশিশ না পেয়ে যে মানুষ অক্সিজেন মাস্ক রোগীর মুখ থেকে খুলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে সে মানুষকে আমি ঘৃণা করি। তবুও সেই নিষ্ঠুর প্রাণীটাকেও মানুষই বলতে হবে আমাদের! একের পর এক ঘটনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে দুর্বল করে ফেলেছে। বারবার সভ্যতার দোহাই দিয়ে নিজেদের জাত উঁচু করার চেষ্টা করছি। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সব অস্বিকার করার চেষ্টা করছি। অথচ আজকের এই সভ্যতার পেছনে কত যুদ্ধ বিগ্রহ জড়িয়ে রয়েছে। কত সভ্যতার মানুষের রক্ত লেগে রয়েছে তার হিসাব নেই। আজ আমরা এমন একটি সভ্যতায় পা রেখেছি যেখানে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ। সবচেয়ে হ্রিংস কে এ প্রশ্নের উত্তরও হবে মানুষ। সবচেয়ে লোভী আর অহংকারী প্রাণীটির নামও মানুষ। মানুষকে ঠকিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা করে এই আধুনিক সভ্যতার মানুষগুলোই।
বিবেক-বোধ, জ্ঞান,সংযম,প্রেম সবকিছু বর্জন করে আঁকড়ে ধরে আছি মিথ্যে অহমিকাকে। যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষের সাথে সাথে মানবিক সভ্যতা বিলীন হতে আরম্ভ করেছে। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে এই মানবতার সংকট তত ঘনিভূত হচ্ছে। নিত্য নতুন ডিজাইনের পোশাক গায়ে দিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছি কিন্তু প্রকৃত লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছি। আজ ঘুষখোর, চাঁদাবাজ,লম্পট বললেও কেউ তেমন একটা রাগ করে না। ঘুষ খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ নিহিত! যেখানে মন নেই,রুচি নেই,মনুষ্যত্ব নেই,বিবেক নেই,ঘৃণা নেই,মানবিকতা নেই সেখানে কোন সভ্যতার উত্তরণ ঘটছে জানি না। আমরা আজও নিজেদের মানুষ বলেই পরিচয় দেই! আশ্চর্য!
[ শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক ]