জমজম। একটি প্রসিদ্ধ কূপ। এটি পবিত্র নগরী মক্কার মসজিদে হারামের ভেতরে অবস্থিত একটি কূপ। দিকের হিসেবে এটি কাবা শরিফ থেকে ২০ মিটার তথা ৬৬ ঠুট পূর্বে অবস্থিত। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রী ও সন্তান হজরত হাজেরা ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের স্মৃতি ধন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা- জমজম কূপ।
ইসলামের ইতিহাসের বর্ণনা মতে, আল্লাহর বন্ধু হজরত ইবরাহিম আলাইহি সালাম তাঁর স্ত্রী ও প্রিয় সন্তান ইসমাঈলকে জনমানবহীন মরুভূমিতে রেখে আসেন। পানির সংকট হলে তাঁর স্ত্রী হজরত হাজেরা ও তাঁর শিশুছেলে হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মরুভূমিতে রেখে আসার পর একসময় পানি সঙ্কট দেখা দেয়। পরে শিশু হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের পায়ের আঘাতে এর সৃষ্টি হয় মর্যাদার এ কূপ জমজম।
সময়ের পরিক্রমায় মর্যাদার এ কূপটি বন্ধ হয়ে যায়। মাটিতে ঢাকা পড়ে কূপটি। পুনরায় এটি খননের বিষেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা রয়েছে। সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হলো-
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের আগে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব স্বপ্নযোগে কূপ খননের বিষয়ে এ মর্মে আদিষ্ট হন যে, তাঁকে যমযম কূপ খননের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং স্বপ্নযোগে তার স্থানও নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।
স্বপ্নের চিহ্নিত স্থান অনুযায়ী তিনি তার পুত্র হারেসকে সঙ্গে নিয়ে কূপ খননকার্য শুরু করেন এবং বাস্তবেই জমজম কূপ আবিষ্কারে সক্ষম হন। খনন কাজ চলাকালে কূপ থেকে সেসব জিনিসও তিনি উত্তোলন করেন, বনু জুরহুম গোত্র মক্কা ছেড়ে যাওয়ার আগে কূপের মধ্যে যা নিক্ষেপ করেছিলেন।
নিক্ষিপ্ত দ্রব্যের মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক তলোয়ার ও লৌহবর্ম এবং দুইটি সোনার হরিণ।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাদা আবদুল মুত্তালিব তলোয়ারগুলো দ্বারা কাবা শরিফের দরজা ঢালাই করেন এবং সোনার হরিণ দুটি কাবা শরিফের দরজার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে রাখেন। আর হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেন।
জমজম কূপ খননকালে আরও যে ঘটনাটির উদ্ভব হয়েছিল তা হচ্ছে-
যখন কূপটি প্রকাশিত হয় তখন কুরাইশগণ আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে বিবাদ শুরু করেন এবং দাবি করেন যে, জমজম কূপ খনন কাজে তাদেরকেও অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে।
কুরাইশদের দাবির প্রেক্ষিত আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘যেহেতু এ কূপ খননের জন্য তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়েছেন সেহেতু এর খনন কাজে তাঁদের অংশগ্রহণ করতে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য কুরাইশগণও তাদের দাবি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।
খনন কাজে অন্যান্যের অংশ নিতে মতামত গ্রহণ
জমজম কূপ খনন কাজে অন্য কুরাইশদের যোগদান করার বিষয়ে মতামতের জন্য তাঁরা বনু সাদ গোত্রের ভবিষ্যদ্বক্তা এক নারীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু পথের মধ্যে তাঁরা এমন কতিপয় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন যাতে তাঁদের কাছে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তাআলা জমজম কূপের খনন কাজ আবদুল মুত্তালিবের জন্যই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই তাঁরা আর সামনে অগ্রসর না হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আবদুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে, আল্লাহ তাআলা যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে ১০টি ছেলে সন্তান দান করেন এবং সবাই বয়োপ্রাপ্ত হয়ে জীবনের এ স্তরে গিয়ে পৌঁছে যে তাঁরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম। তাহলেই তিনি তাঁর একটি সন্তানকে বাইতুল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন।
জমজম কূপের সংস্কার
জমজম কূপ বেশ কয়েক বার সংস্কার করা হয়। প্রথম থেকে এটি বালি ও পাথর দিয়ে ঘেরা অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে খলিফা আল মনসুরের সময় ৭৭১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৫৪/১৫৫ হিজরিতে এর উপর গম্বুজ এবং মার্বেল টাইলস বসানো হয়। পরবর্তীতে খলিফা আল মাহদি এটি আরো সংস্কার করেন।
সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ সালে সৌদি বাদশাহ সংস্কার করেন। বর্তমানে কূপটি কাবা শরিফ চত্বরে দেখা যায় না। এটি ভূগর্ভস্থ অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং এখানে থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হয়। যা পবিত্র দুই মসজিদ মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববিতে সরবরাহ করা হয়।
জমজম কূপের পানির ফজিলত
তখন থেকে আবার মানুষ এ কূপের যতœ নিতে শুরু করেন। জমজম কূপ পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্রতম, বরকতময় কূপ। এর পানি পৃথিবীর সর্বোত্তম ও সুস্বাদু পানি।
হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায এ পানির কল্যাণের কথা ওঠে এসেছে। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, জমজমের পানি যে নিয়তে (নেক উদ্দেশ্যে) পান করা হয় তা পূরণ হয়। জমজমের অশেষ কল্যাণ ও বরকতের কথা অনেক হাদিসে রয়েছে।
হজরত আবুবকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জমজমের পানি সম্পর্কে বলেছেন, যে তা হচ্ছে বরকতময় এবং তৃপ্তিদায়ক।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বোত্তম পানি হচ্ছে জমজমের পানি।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে পানি উত্তোলন করতেন এবং পান করতেন। জমজমের পানি শুধু তৃষ্ণাই নিবারণ করে না, এর মধ্যে ক্ষুধাও নিবারণের যোগ্যতা রয়েছে। এ পানি মানুষের শরীরের স্বস্তিও প্রবৃদ্ধি করে এবং হজমে সহায়তা করে।