দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিপুলসংখ্যক অনুসন্ধান ও তদন্তই মেয়াদোত্তীর্ণ। বিদ্যমান আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ অনুসন্ধান এবং ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। দুদকের মেয়াদোত্তীর্ণ মোট অনুসন্ধান ও মামলার তদন্তের হার ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দুদকের মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ১ হাজার ১১৯টি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ তদন্ত ২০৩টি। তবে দুদক সংশ্লিষ্টদের দাবি, নানা কারণেই অনুসন্ধান ও তদন্তে সময়োত্তীর্ণ হতে পারে। কারণ দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলের মামলাগুলোও এখনো তদন্ত করা হচ্ছে। আর অনুসন্ধান ও তদন্তে যদি কোনো কর্মকর্তার বড় ধরনের গাফিলতি থাকে এবং তারা যদি উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ক্ষতিকারক কাজ করে থাকে তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুদক আইনের ২০(ক) ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নতুন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে কমিশন। আর ২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালার ৭ বিধিতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। আর ওই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আরো ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন। আর ২০(খ) অনুযায়ী তদন্তে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগে কমিশন আইন বা প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে কমিশন। আর ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯ ও ২০ ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে দুদককে বিশেষ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। তবে কমিশন ব্যর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে নজির সৃষ্টি করতে পারেনি।
সূত্র জানায়, দুর্নীতির অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ না করার পেছনে প্রধানতম দুটি কারণ রয়েছে। তার প্রথমটি হলোকমিশনের জনবল সঙ্কট। বর্তমানে কমিশনে প্রায় ২০০ জন অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা রয়েছে। আর জনপ্রতি তাদের কাঁধে ৩০টি অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে সব কাজ শেষ করতে কর্মকর্তারা হিমশিম খাচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো অন্যান্য সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতা। দুদকের মামলা করতে হয় তথ্যপ্রমাণভিত্তিক। সেজন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জন্য আবশ্যক। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের অন্য দপ্তরগুলো চাহিদা অনুসারে তথ্য সরবরাহ করে না। ফলে সঙ্গত কারণেই অনুসন্ধান ও তদন্ত বিলম্ব হয়।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, দুদকের সামর্থ্য ও সক্ষমতার তুলনায় দেশে দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ-সংক্রান্ত মামলা অনেক বেশি। তাছাড়া কমিশনে আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি রয়েছে। আর দুদক থেকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয় যে, দুদকের কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি বিরাজ করছে। ফলে কারোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে একশ্রেণির দুদক কর্মকর্তা সেটাকে সুযোগ হিসাবে দেখে এবং তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ছাড় দিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে দু-একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। কমিশন এ বিষয়টি অনুধাবন করা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
অন্যদিকে অনুসন্ধান বা তদন্ত আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করার ক্ষেত্রে দুদকের ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলে উচ্চ আদালত মনে করছেন। বিশেষ বিধান থাকার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান-তদন্ত শেষ না করায় সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের মতে, দুদক আইনের ৩২ ধারা ও বিধি ১৫ অনুযায়ী কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা এবং দক্ষতার সঙ্গে বিচার কাজ শেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই দুর্নীতি ও দুর্নীতিচর্চা নির্মূল হবে। যদি কমিশনের কোনো কাজ, আদেশ, কার্যপ্রণালি এবং নিষ্ক্রিয়তা সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এবং দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন যদি যথাযথ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নীরবতা অবলম্বন করে, তবে সব প্রচেষ্টাই ব্যাহত হবে।
এ প্রসঙ্গে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেলক হক খান জানান, এখন পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে এর সংখ্যা কেমন, সমস্যা কোথায়, সমস্যা থাকলে তা কোন পর্যায়ে আছে। তার জন্য একটা গবেষণা শুরু করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের কিছু ভুলভ্রান্তি রয়েছে। দেশের স্বার্থেই আইনানুগভাবে দুদকের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।